চট্টগ্রামে ‘জয় বাংলা’র পুরনো ভিডিও নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী নতুন মামলা, সময় ও প্রমাণ নিয়ে প্রশ্ন
মেটাডাটায় ধরা পড়ল সময়ের ফারাক
চট্টগ্রামে কয়েক মাস আগের একটি ভিডিওকে ‘সাম্প্রতিক’ দেখিয়ে কেন্দ্র করে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইনে’ মামলা দায়ের হয়েছে। মামলায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৬০ থেকে ৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর চরলক্ষ্যা এলাকায়, যা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

মামলার সূত্র ও অভিযোগের বিবরণ
শনিবার (১ নভেম্বর) কর্ণফুলী থানায় মামলাটি দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেন নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহেদুল ইসলাম। মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২০ অক্টোবর রাত তিনটার দিকে কর্ণফুলীর চরলক্ষ্যা এলাকার তাজ কমিউনিটি সেন্টারে নয়জন যুবক ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিচ্ছিলেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা হয়। অভিযোগে বলা হয়, তারা রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তারা পালিয়ে যান।
পরে স্থানীয় সূত্র ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পাঁচজনকে শনাক্ত করা হয়। তারা হলেন কর্ণফুলীর চরলক্ষ্যা এলাকার মো. দিদার হোসেন চৌধুরী (২৬), মো. আরিফ (২৫), নাজু (২৮), মো. দিদার (২৫) ও মো. সাব্বির হোসেন (৩০)। অন্য আসামিরা চরপাথরঘাটা ও খোয়াজনগর গ্রামের বাসিন্দা।
সময় নিয়ে প্রশ্ন ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া
মামলার এজাহারে ঘটনাটির তারিখ ২০ অক্টোবর দেখানো হলেও ওসি জাহেদুল ইসলাম দায়িত্ব নেন ২৩ অক্টোবর। কিন্তু মামলা রেকর্ড হয় ১ নভেম্বর—অর্থাৎ ঘটনার ১২ দিন পর। রেকর্ডিং কর্মকর্তা হিসেবে নাম আছে ওসি তদন্ত রফিকুল ইসলামের। এতে মামলার সময়, প্রক্রিয়া ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কর্ণফুলী থানার এসআই রুহুল আমিন বাদী হয়ে সন্ত্রাস বিরোধী আইন (২০০৯) সংশোধনী ২০১৩–এর ৬(২), ৮, ৯ ও ১০ ধারায় মামলা রুজু করেন। মামলার নম্বর ৩।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কর্ণফুলী থানার এসআই জুয়েল মজুমদার আদালতে জানান, অভিযান চালিয়ে ধুপ পুলের গোড়া থেকে ২ নম্বর আসামি মো. আরিফ (২৫)–কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।
ভিডিও বিশ্লেষণ ও দিদারের দাবি
ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে বসে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিচ্ছেন। স্থানীয়রা ভিডিওতে দিদার হোসেন চৌধুরীকে শনাক্ত করেন বলে জানা গেছে।
তবে দিদার হোসেন দাবি করেছেন, ভিডিওটি তার গ্রেপ্তারের কয়েক মাস আগের। তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘আমাকে নিয়ে ফের ষড়যন্ত্র, ভিডিওটা আমি গ্রেপ্তার হওয়ার আগের ভিডিও।’ দিদার ৬০ দিন জেল খেটে বেরিয়ে জানান, ভিডিওটি তার গ্রেপ্তারের কয়েক সপ্তাহ আগের। রেকর্ড অনুযায়ী, তিনি ১১ আগস্ট গ্রেপ্তার হন এবং ৯ অক্টোবর জামিন পান। তার বিরুদ্ধে কর্ণফুলী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তিনটি মামলা রয়েছে— ২১, ২৫ ও ২৭ নম্বর মামলা।
অনলাইন মেটাডাটা কী বলছে
ভিডিওটি কখন ধারণ করা হয়েছিল, তা জানতে চট্টগ্রাম প্রতিদিন অনলাইন মেটাডাটা বিশ্লেষণ টুল যেমন সার্কেল অ্যানিমেশন, এক্সিফ টুল, মিডিয়া ইনফো এবং মেটাডেটা টু গো সেবাগুলো ব্যবহার করে। এতে দেখা যায়, ভিডিওটি সাম্প্রতিককালের নয়, এটি কয়েক মাস আগেই আপলোড করা হয়েছিল বলে ধারণা মেলে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি যাচাই করতে বিশেষজ্ঞ সংস্থা যেমন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) তদন্ত করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনজীবী ও পুলিশের বক্তব্য
চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিহাব বলেন, পুলিশের উচিত সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা করা। দুর্বল এজাহার আদালতে টিকতে পারে না। কাউকে হয়রানি করতে মামলা করা অনৈতিক এবং আইনি দৃষ্টিতে টেকসই নয়।
অন্যদিকে কর্ণফুলী থানার নবাগত ওসি মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, তিনি ভিডিওটি দেখেছেন, তবে আগে এ বিষয়ে মামলা হয়েছিল কি না, তা জানেন না। তিনি বলেন, তদন্তে দেখা হবে ভিডিওটি আসলে কবে ধারণ করা হয়েছিল। নিরাপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না।
তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন
পুরনো ভিডিওর ভিত্তিতে নতুন মামলা দায়ের করায় পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া ও তথ্য যাচাইয়ের মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আইন অনুযায়ী কোনো মামলায় সময়, স্থান ও ঘটনার নির্ভুলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অস্পষ্ট প্রমাণ বা পুরনো ঘটনার ওপর মামলা করলে তা আদালতে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রশাসনের প্রতি জনআস্থা কমে যায়।
তবে যদি ভিডিওটি সাম্প্রতিক হয় এবং আইনবিরোধী কার্যকলাপের প্রমাণ মেলে, তাহলে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়াই হবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
তথ্য যাচাই সংস্কৃতি চালুর দাবি
অপরাধবিশেষজ্ঞদের মতে, কর্ণফুলীর এই ঘটনাটি দেখিয়ে দিয়েছে, পুলিশের এখন প্রয়োজন ‘ফ্যাক্ট-চেকিং কালচার’ গড়ে তোলা। ডিজিটাল যুগে প্রতিটি ভিডিও, ছবি বা পোস্টের মেটাডাটা যাচাই করা প্রযুক্তিগতভাবে সহজ। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা ও প্রশিক্ষণ।
জেজে/সিপি



