চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতাদের নেতৃত্বে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের বড় চক্র, দামপাড়ায় টর্চার সেল

হাতে পাহাড়তলী থানা লুটের অস্ত্র

চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় অন্তত দুজন শীর্ষ ছাত্রদল নেতার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ একটি চক্র বিভিন্নজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে। নগরীর ভেতরেই ব্যস্ততম এলাকায় তারা গড়ে তুলেছে রীতিমতো টর্চার সেল। গত একমাসে সেখানে বহু লোককে ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে— এমন তথ্য জানা গেছে বিভিন্ন সূত্রে। প্রটেকশনের বিনিময়ে এর ভাগ পান নগর ছাত্রদলের এক শীর্ষ নেতাও।

মিরসরাই পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়র গিয়াস উদ্দিন
মিরসরাই পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়র গিয়াস উদ্দিন

ব্যস্ত সড়কে পিস্তল ঠেকিয়ে অপহরণ

গত শুক্রবার (৩০ আগস্ট) দুপুর আড়াইটার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন চট্টগ্রামের মিরসরাই পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়র গিয়াস উদ্দিন। তিনি মিরসরাই পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতিও। সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে হঠাৎ তাকে ঘিরে ধরে ছয় থেকে সাত যুবক। এদের মধ্যে একজন ব্যস্ততম সেই সড়কে প্রকাশ্যেই পিস্তল ঠেকায় তার মাথায়। গিয়াস উদ্দিন চিৎকার করে লোকজনের সাহায্য চাইলেও এগিয়ে আসার সাহস করেনি কেউ।

অস্ত্রধারী যুবকরা মুহূর্তেই গিয়াসকে সেন্ট্রাল প্লাজার পাশের গলির ভেতরে একটি ভবনের নিচের তলায় নিয়ে যায়। গলির ভেতরে পূর্বদিকে মাঠের পাশে কোচিং সেন্টার সংলগ্ন সেই ভবনের সিঁড়ির পাশে ছোট্ট একটি রুমে তাকে আটকে রাখা হয়।

এ সময় অস্ত্রধারী যুবকরা সাবেক পৌর মেয়র গিয়াসের গলায় ধারালো ছুরি ধরে প্রথমে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এ সময় তারা গিয়াসের পকেটে থাকা ৩৫ হাজার টাকাসহ দুটি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়।

বিকেল পৌনে চারটার দিকে ওই কক্ষে আসেন খুলশী থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব নুর আলম সোহাগ। তিনি আসার কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে যাওয়ার সময় সহযোগী যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘একটু পর আমাদের দলীয় প্রোগ্রাম আছে। এরে আপাতত এখানে তালা মেরে রাখ।’

গ্রিনলাইন কাউন্টারের পেছনে ‘টর্চার সেল’

সন্ধ্যা সাতটার দিকে অস্ত্রধারী যুবকরা ফিরে এসে সাবেক পৌর মেয়র গিয়াসের মুখে কাপড় ও হাত রশি দিয়ে বেঁধে সিএনজিচালিত একটি ট্যাক্সিতে তোলে। সেই ট্যাক্সি গিয়ে থামে দামপাড়া গ্রিনলাইন বাস সার্ভিসের কাউন্টারের সামনে। ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কাউন্টারের পেছনে বাস রাখার মাঠে একটি কড়ই গাছের নিচে। গিয়াসকে সেখানে ব্যাপক মারধর করা হয়। এর মধ্যে এক যুবক পিস্তল ঠেকিয়ে গিয়াসের মাথায় গুলি করে। তবে গুলির বিকট শব্দ হলেও গুলি বের হয়নি। ছাত্রদল নেতা নুর আলম সোহাগ মারধরের পুরো সময়টায় নিজে উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

ঘটনার শিকার গিয়াস উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাকে যখন গ্রিনলাইন কাউন্টারের পেছনের মাঠটিতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সেখানে এক কোণায় আরও দুজনকে দেখেছি, যাদের দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল। চোখও তাদের কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। আমাকে তারা একটি কড়ই গাছের নিচে নিয়ে বসায়। এরপর এমনভাবে তারা আমাকে মেরেছে আমার পরনের কাপড়চোপড়ও ছিঁড়ে যায়।’

গ্রিনলাইন কাউন্টারের পেছনের সেই মাঠে অনেকগুলো অস্ত্রও দেখেছেন গিয়াস উদ্দিন। এর মধ্যে দুটি শাটারগানে চট্টগ্রাম নগরীর ‘পাহাড়তলী থানা’র নাম লেখা ছিল। গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘এগুলো সরকার পতনের পর থানা থেকে লুট করা অস্ত্র হতে পারে। দুটি পিস্তলও দেখেছি।’

এরই মধ্যে গিয়াসের পরিবারের সদস্যরা চকবাজার থানা ও চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর ইলিয়াস ফেরদৌসকে ঘটনাটি জানান।

মুক্তিপণ ২০ থেকে ওঠে ৩০ লাখে

গ্রিনলাইন কাউন্টারের পেছনে অস্ত্রধারীরা ব্যাপক মারধর করার পর গিয়াস উদ্দিনের কাছে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। নইলে তাকে হত্যার হুমকি দেয়। রাত আটটার দিকে সেখানে ঢোকেন মিরসরাই পৌর যুবদলের সদস্যসচিব বোরহান উদ্দীন সবুজ। এর পরপরই মুক্তিপণের টাকার অংক আরও ১০ লাখ বেড়ে ৩০ লাখ টাকায় ওঠে যায়।

একপর্যায়ে মুক্তিপণের টাকা জোগাড়ের জন্য মিরসরাইয়ের ছাত্রদল নেতা সবুজের ফোন থেকে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন গিয়াস উদ্দিন। সবুজ পরে ঘটনার সঙ্গে সোহাগের জড়িত থাকার কথা জানায় গিয়াসের পরিবারকেও। এরপর থেকে সোহাগের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হতে থাকে গিয়াসের স্বজনদের সঙ্গে।

রাত ৯টার দিকে গিয়াসের পরিবার থেকে দাবি করা টাকার একাংশ জোগাড়ের কথা জানানোর আধঘন্টা পর সিএনজি ট্যাক্সি করেই জিইসি মোড়ে অবস্থিত ‘কাচ্চি এক্সপ্রেসে’র দোতলায় নিয়ে যাওয়া হয় গিয়াসকে। একটি টেবিলে বসিয়ে গিয়াসকে স্বাভাবিক আচরণ করার নির্দেশ দিয়ে যুবকদের দুজন গিয়াসের দুই পাশে বসে। কাচ্চি এক্সপ্রেসে ঢোকার মুখে ছিল আরও অন্তত ২০ যুবক।

টাকা গোণা হয় পুলিশবক্সের ভেতরে

রাত সাড়ে ১০টার দিকে গিয়াস উদ্দিনের স্বজনরা নগদ ১৫ লাখ টাকা জোগাড় করে নিয়ে আসে। খুলশী থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব নুর আলম সোহাগের উপস্থিতিতে সেই টাকা গোণা হয় জিইসি মোড়ের পশ্চিম পাশের পুলিশ বক্সের ভেতরে। সেখান থেকে মোবাইলে টাকা বুঝে পাওয়ার বার্তা যায় গিয়াসের পাশে বসে থাকা এক যুবকের মোবাইলে।

এর পরপরই মুক্তি মেলে গিয়াস উদ্দিনের। রাত ১১টার দিকে পরিবারের কাছে ফিরে যান তিনি।

মোবাইলে ছিনিয়ে ভুয়া এসএমএস

মুক্তির পর ঘটে আরেক কাণ্ড। গিয়াসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুটি মোবাইল থেকে গত কয়েকদিন ধরে কনট্যাক্ট লিস্টে থাকা বিভিন্নজনের কাছে ‘আমি হঠাৎ বিপদে পড়ে গেছি। আমার এই মুহূর্তে কিছু টাকার দরকার’— এমন এসএমএস পাঠিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্রটি।

সাবেক পৌর মেয়র গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘এভাবে তারা প্রায় দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আমার পরিচিতজনদের কাছ থেকে। পরে আমি নতুন করে সিম তুলেছি।’

গত মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) ঘটনার শিকার গিয়াস ছাত্রদল নেতা নুর আলম সোহাগের কাছে ফোন করে মোবাইলগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালে সোহাগ বলেন, ‘আপনারে তো সেনাবাহিনীতে দিইনি, পুলিশে দিইনি। শুধু টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।’

গ্রিনলাইন কাউন্টারের পেছনের মাঠে মারধরে লিভারে বেশ আঘাত লেগেছে— এমন কথা জানিয়ে গিয়াস বলেন, ‘আমার চোখেও খুব আঘাত লেগেছে।’

তারা যা বললেন

ঘটনার বিষয়ে জানতে মূল অভিযুক্ত খুলশী থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব নুর আলম সোহাগের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের এই চক্রে সোহাগসহ ২০ থেকে ২৫ জন জড়িত থাকলেও অন্তত দুজনকে শনাক্ত করেছেন গিয়াস উদ্দিন। ওই দুজন হলেন— বরিশাল কলোনির রাজু এবং জাহাঙ্গীর ওরফে টুকু মোল্লা।

তবে ছাত্রদল নেতা বরিশাল কলোনির রাজু বলেন, ‘আমাকে কেউ ফাঁসানোর চেষ্টা করতেছে হয়তো। রাজনৈতিকভাবে আমাদের বিভিন্নজনের সাথে সমস্যা থাকতে পারে। সেটার জন্য এখানে ফাঁসানোর চেষ্টা করতে পারে। তবে আমি এ ধরনের কোনো কাজে জড়িত ছিলাম না। যে লোক বলতেছে, তাকে আমার ছবি দেখান। ওনি দেখলে নিশ্চয় চিনতে পারবেন। অন্য কারও জায়গায় হয়তো আমার নাম জড়িয়ে দিচ্ছে।’

নুর আলম সোহাগ চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলের সদস্য সচিব শরিফুল ইসলাম তুহিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। শরিফুল ইসলাম তুহিন আবার বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মীর হেলালের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

অভিযোগ সম্পর্কে শরিফুল ইসলাম তুহিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ এমন অভিযোগ দেয় নাই। অফিসিয়াল কোনো নোটিশও আমরা পাইনি। আর যে ব্যক্তির কথা বলতেছে, সে নিজেই একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী। বিষয়টা এখনও পর্যন্ত এটা একটা প্রোপাগান্ডা। সেন্ট্রালের সাথে এ বিষয়ে এখনো আমাদের কোনো কথা হয়নি।’

তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেছেন, ‘আমরা ঘটনাটি জেনেছি। সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কিছু কথা আছে। সেগুলো আমরা তদন্ত করার পর সত্যটা জানতে পারবো। তদন্ত শেষ হতে দুই-তিনদিন লাগবে। তারপর আমরা যেটা ব্যবস্থা নেওয়ার সেটা নেবো।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm