প্রবাসী বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে ঘরবন্দি করে মারধরসহ চাঁদাবাজির অভিযোগে চট্টগ্রাম নগরীর মোহরা ওয়ার্ড ‘এ’ ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে চান্দগাঁও থানায়। সেই আওয়ামী লীগ নেতার ‘তদবির’ না রাখায় মিথ্যাচার করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) মো. খাইরুল ইসলাম।
এছাড়া সংবাদকর্মীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন নগর পুলিশ দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার ডিসি মোস্তাফিজুর রহমান।
মামলার আসামিরা হলেন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী নেজাম উদ্দিনের ভাই মো. রফিক (৪৬) ও তার স্ত্রী শারমিন সুলতানা শিফা (২৫), মোহরা ওয়ার্ড ‘এ’ ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম (৪৮), মো. রোহেদ (৩৫) এবং তাদের ভাতিজা মো. আরিফুল ইসলামসহ (৩০) অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচজন। এদের মধ্যে রফিকও সুইজারল্যান্ড থাকেন। সম্প্রতি তিনি দেশে আসেন।
প্রবাসীর স্ত্রীকে মারধর করে ঘরবন্দি করে রাখার ঘটনায় গত ১৪ মে চান্দগাঁও থানার মামলা হয়। সেই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজও রয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রবাসীর তিন ভাই-ভাবী-ভাতিজা মিলে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রবাসীর স্ত্রী ও সন্তানদের ওপর হামলা করেছে।
প্রবাসীর স্ত্রীকে বিবাদিদের দেওয়া নানা হুমকির অডিও রেকর্ড ও মারধরের সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষিত রয়েছে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে।
মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, প্রবাসী নেজাম উদ্দিনের মালিকানাধীন নগরীর চান্দগাঁও সানোয়ারা আবাসিকের মৌলভী পুকুর পাড় সড়কের ৭০২ নম্বর বাড়িতে তার স্ত্রীসহ দুই মেয়ে বসবাস করেন। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে সেই জমির অন্য মালিক প্রবাসীর ভাই মো. রফিকের সঙ্গে বিভিন্ন সময় ঝামেলা চলছিল। এসব সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী নেজামের ছোট ভাই নগরীর মোহরা ওয়ার্ড ‘এ’ ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলামসহ রফিকের স্ত্রী মিলে ওই প্রবাসীর বড় মেয়ের শ্লীলতাহানি করেন। এই বিষয়ে গত বছরের ২৪ নভেম্বর চান্দগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও রয়েছে। পরে পারিবারিক সম্পর্কের কারণে ও বিবাদিদের ভয়ে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসা হয়।
কিন্তু তাদের মধ্যে এসব বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় চলতি মাসের ৮ মে দুপুরে মামলায় অভিযুক্তরা ফের প্রবাসীর স্ত্রী, সন্তানসহ শ্যালক মো. আসিফ (৩০) ও প্রবাসীর স্ত্রীর চাচাতো বোন ফারহানা ইয়াছমিনকে (৪০) মারধর করেন। এই সময় প্রবাসীর স্ত্রীর গলায় থাকা এক ভরি ওজনের স্বর্ণের চেইনও ছিনিয়ে নেয়। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর মামলা দায়ের করেন প্রবাসীর স্ত্রী। এই মামলায় রফিক ও আরিফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা গত ২০ মে আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন।
এই ঘটনায় মামলা দায়েরের পর আমিনুল ইসলাম ও চান্দগাঁও থানা মোহরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জসিম উদ্দিনসহ কয়েকজন মিলে থানায় যান। সেখানে ভিকটিমদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়েরের জন্য ওসিকে তদবির করেন। কিন্তু তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য না থাকায় মামলা নেননি ওসি মো. খাইরুল ইসলাম। মামলা না নেওয়ায় ওসিকে শাসিয়ে যান আওয়ামী নেতারা।
জানা গেছে, এর আগেও নানা বিষয়ে তদবির নিয়ে ওসির কাছে ধরনা দিতেন আওয়ামী নেতা জসিম উদ্দিন। অবৈধ সিএনজি আটক করলে এতেও তদবির করতেন নেতা জসিম। শুধু তা নয়, মারামারির মামলায়ও তিনি তদবির করতেন ওসির কাছে। এছাড়া চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল চান্দগাঁও থানার কাপ্তাই রাস্তার মাথা রেলবিট সংলগ্ন হোসেনের ভাড়াঘর থেকে জুয়ার সরঞ্জামসহ ৯ জুয়াড়িকে আটকের ঘটনায়ও তদবির করতে আসেন জসিম।
তবে এইবার তার অনৈতিক আবদার না রাখায় সংবাদকর্মীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সংবাদ ছপানো হয় বলে জানান চান্দগাঁও থানার ওসি খায়রুল।
চান্দগাঁও থানার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চান্দগাঁও থানায় বর্তমানে প্রতিমাসে অর্ধশত মামলা পড়ে। যা পূর্বে ২৫ থেকে ৩০টির বেশি ছিল না। এছাড়া যে কোনো ভিকটিমের বিশ্বাসযোগ্য ঘটনায় মামলা দায়ের হয় থানায়। যা থানা এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ফলপ্রসূ।
চান্দগাঁও থানার ওসি মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘ভিত্তিহীন বিষয়ে তদবির করতে এসেছিলেন নগরের মোহরা ওয়ার্ড ‘এ’ ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও চান্দগাঁও থানা মোহরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জসিম উদ্দিন। তাদের আইন পরিপন্থী তদবিরে কর্ণপাত না করায় ভিত্তিহীন এক তথ্য দিয়ে তারা সংবাদকর্মীদের বিভ্রান্ত করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক প্রবাসীর স্ত্রী-সন্তানকে হামলার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে আমরা মামলা নিয়েছি। কিন্তু তারা সেই ঘটনার ভিকটিমের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে আসেন। বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য দিতে না পারায় মামলা নেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছি।’
ওসির বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে যোগাযোগ করা হলে চান্দগাঁও থানা মোহরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘জমি বিরোধের জেরে ভাইদের মধ্যে কলহ হয়েছে। এই বিষয়ে মামলা না নিয়ে দু’পক্ষকে ডেকে সমঝোতা করা যেত। কিন্তু তিনি তা না করে মামলা নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পরে বিবাদি পক্ষ থেকে মামলা করতে চাইলে তিনি মামলা নেননি। এছাড়া তিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়টি উল্লেখ করেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে নগরীর মোহরা ওয়ার্ড ‘এ’ ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের ডিসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রবাসীর স্ত্রীকে মারধরসহ ঘরের সামনে ময়লা-আবর্জনা রেখে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। এই ঘটনায় মামলা নেওয়ায় তথাকথিত ভূঁইফোড় লেবাসধারী রাজনীতিবিদ একটি সংবাদপত্রে মিথ্যা তথ্য দিয়ে একটি নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করিয়েছেন, যার কোনো সত্যতা নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণও তারা দিতে পারেনি। তারা পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এমন কাজ করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তথ্য-উপাত্ত ছাড়া এই ধরনের কথা বলা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সেই প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মামলা দায়েরের পর থেকে রফিক তার স্ত্রীকে নিচতলার ঘর থেকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেছে। এরপর আমাদের গেটের সামনে মাটি ফেলে আমাদের চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ৯ দিন যাবত আমরা ঘরবন্দি রয়েছি। আওয়ামী লীগ নামধারী আমিনুল ইসলাম আমার বড় মেয়ের শ্লীলতাহানি করেছে। ভাতিজি মানে নিজের মেয়ে, মেয়ে মায়ের মত সম্মানের। কিন্তু সে আমার মেয়েকে বাসার কাজের ছেলের সামনে শ্লীলতাহানি করেছে। এছাড়া দোতলার বাসা থেকে নামলে কুপিয়ে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে।’
আরএস/ডিজে