চট্টগ্রামে ‘করোনা হাসপাতাল’ নিয়ে ক্লিনিক সিন্ডিকেট এবার সরকারের দ্বারস্থ
সরকারি সিদ্ধান্তকে পাশ কাটাতেই অভিনব চালাকি
সরকারি প্রজ্ঞাপনের তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিকদের সিন্ডিকেট হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল নিয়ে পদে পদে মিথ্যাচার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে জাতীয় এই দুর্যোগে যেমন বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা আক্রান্ত রোগীদের নাগালের বাইরে থাকছে, তেমনি সরকারি প্রজ্ঞাপন না মেনে নিজেদের সিদ্ধান্তে চলার বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। সরকার থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপন এখনও বাতিল হয়নি। অথচ সেটাকে পাশ কাটিয়ে হঠাৎ হলি ক্রিসেন্ট নিয়ে তোড়জোড়— এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গত ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে বিভাগীয় কমিটির সভার চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সদস্যরা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ১২টি হাসপাতালের তালিকা চূড়ান্ত করেন। ৪ ধাপে পর্যায়ক্রমে ওই হাসপাতালগুলোর আইসিইউ বেড ব্যবহারের কথা জানিয়ে গত ৪ এপ্রিল একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ। ১২টি হাসপাতালে শতাধিক আইসিইউ বেড রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতি ধাপে তিনটি করে হাসপাতাল এবং ওই তিনটির সিট পূর্ণ হলে পরের তিনটি ব্যবহার করা হবে বলে ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল।
এরই মধ্যে ক্লিনিক মালিকদের একটা অংশ হঠাৎ করেই চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী জাকির হোসেন সড়কের পরিত্যক্ত হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে সামনে নিয়ে আসেন। শুরুতে ১০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল বলে বাজেট প্রচার করা হয়েছে ১২ থেকে ১৪ কোটি টাকা। চালু করার কথা ছিল ২৫ এপ্রিলের মধ্যে।
২৫ এপ্রিল ১০০ শয্যার হাসপাতাল চালুর কথা থাকলেও প্রতিদিন ‘২-১ দিনের মধ্যে চালু হয়ে যাচ্ছে’ এমন প্রতিশ্রুতি দিতে দিতে ৭ মে পর্যন্ত ঠেকেছে সেই ২-১ দিন। সিদ্ধান্তই হয়নি কখন চালু হবে আর কিভাবে পরিচালিত হবে। ফলে তিন কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম বিভাগের করোনার চাপ সামলাতে হচ্ছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল আর ফৌজদারহাটের বিশেষায়িত হাসপাতাল বিআইটিআইডিকে।
১২ থেকে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে করোনার রোগীদের জন্য হাসপাতাল চালু করার কথা বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়া ক্লিনিক সিন্ডিকেটের ওই ব্যবসায়ীরা কিছুটা বাহবা কুড়ালেও অনেকের মনে শঙ্কা ছিল সেই শুরু থেকেই। পরে দেখা গেলো সর্বোচ্চ খরচ তাদের এক থেকে দেড় কোটি টাকা। ভেন্টিলেটরসহ ২০টি আইসিইউ এবং ৮০টি আইসোলেশন শয্যার কথা থাকলেও ৫ মে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে বৈঠকে জানানো হয় ১০টি আইসিইউ এবং ২০ থেকে ২৫টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত আছে।
অর্থায়ন প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, ৫০টি ক্লিনিকের মালিকদের সম্পৃক্ততা আছে হলি ক্রিসেন্টের এই কথিত হাসপাতালের সঙ্গে। কিন্তু কমপক্ষে আটটি ক্লিনিকের মালিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে। তাদেরকে কোন বৈঠকে কখনও ডাকেনি এই সিন্ডিকেট। এই সমিতির কার্যকারিতা নিয়েও তাদের মধ্যে আছে প্রশ্ন। হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালের সংস্কারের জন্য ৩ লাখ টাকা চেয়ে সদস্যদের চিঠি দিয়েছে ক্লিনিক মালিক সমিতি।
এই চিঠিকে চাঁদাবাজির সাথে তুলনা করে একটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘ভিন্নমতের মানুষদের মালিকানায় থাকা ক্লিনিকগুলোকে বলপ্রয়োগ করে তাদের থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করে হলিক্রিসেন্টের পিছনে খরচ করা হচ্ছে। খরচের স্বচ্ছতা নিয়েও আমাদের প্রশ্ন আছে। সমিতির কার্যকারিতা থাকলে তো আমরা অন্য প্রোগ্রামের দাওয়াত পেতাম, সমিতির আয়-ব্যয়ের হিসাবও জানতাম। কিন্তু চিঠি পাওয়ার আগে জানতামই না আমি এরকম একটি সংগঠনের সদস্য! চিঠি একটা দিয়ে টাকা চাওয়া তো এক প্রকার চাঁদাবাজিই।’
চট্টগ্রাম নগরীর আরেকটি ক্লিনিকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স নেই। করোনার পর সেটার অস্তিত্বই যদি না থাকে সুনাম অর্জন বা ধরে রাখার বিষয়টিও থাকবে না। তাদের জবাবদিহিতাও থাকছে না, দায়বদ্ধতাও থাকছে না। কোন ভরসায় রোগীরা ওখানে আসবে? কে তার স্বজনকে এমন অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলবে?’
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘১২টি ক্লিনিকের আইসিইউ ব্যবহারের একটা সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এখনও সেটা বাতিলের কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। বাতিল না করে সেটাকে পাশ কাটিয়ে অন্য সিদ্ধান্তে যাওয়া মানে হলো সরকারি সেই আদেশকে অসম্মান করা।’
এসব অনিশ্চয়তা, ১০০ শয্যার স্থলে ৩৫ শয্যা এবং ধারাবাহিক লুকোচুরির মধ্যে চসিক মেয়রের কার্যালয়ে বসেছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবির, ডিজিএফআই চট্টগ্রামের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কবীর আহাম্মদ, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. শামীম হাসান, জেলা সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি, বিএএম চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবালসহ বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতি চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. লিয়াকত আলী খান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়ে হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালকে চমেক হাসপাতালের অধীনে করোনা ইউনিট হিসেবে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’
চকেম হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমি বৈঠকে বলেছি আমার বর্তমান জনবল দিয়ে হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল পরিচালনা সম্ভব নয়। চমেক হাসপাতালের ধারণক্ষমতার চেয়ে কমপক্ষে তিন গুণ রোগীর চাপ রয়েছে। এমনিতেই আমরা এই জনবল দিয়ে হাসপাতাল চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। হলিক্রিসেন্ট আমাদের পরিচালনা করতে দিলে দুই দিকই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তবে সরকার নতুনভাবে যে নিয়োগ দিয়েছে সেখান থেকে যদি হলিক্রিসেন্ট পরিচালনার জন্য নতুন জনবল দেয় সে ক্ষেত্রে তা করা যাবে।’
বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল বলেন, ‘করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী অন্য রোগীদের সাথে মিশলে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এজন্য আলাদা হাসপাতাল প্রয়োজন। চিকিৎসকসহ সব কিছু ডেডিকেটেড হতে হবে। সেই বৈশিষ্ট্য নিয়েই হলি ক্রিসেন্টকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি পরিচালনায় মাসিক কমপক্ষে সাড়ে ৩ কোটি টাকা খরচ হবে। এই খরচ ক্লিনিক মালিক সমিতির পক্ষে বহন করা সম্ভব নয় বলাতে সরকারকে পরিচালনার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। আবার সরকার ঘোষিত প্রণোদনা শুধু সরকারি চিকিৎসকদের জন্য। অন্য চিকিৎসকরা সেই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করবেন না। হলিক্রিসেন্টের বিকল্প হিসেবে আমরা প্রস্তাব করবো যে কোন একটি প্রাইভেট হাসপাতালের পরিচালনার ভার সরকার গ্রহণ করুক। তাদের যাবতীয় ব্যয় বহন করে একটি হাসপাতাল করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় অধিগ্রহণ করে পরিচালনা করুক।’
আরেক চিকিৎসক নেতা বলেন, ‘মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তো নগরীর এক পাশে রয়েছে। যারা হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল, প্রাইভেট হাসপাতাল নিয়ে এত বৈঠক, এত কিছু করতেছেন তারা চাইলে তো ওই হাসপাতালটি করোনার রোগীদের জন্য নির্ধারণ করতে পারেন। ওটা তো ওদের নিজেদেরই আয়ত্বে রয়েছে।’
সরকারি দলের রাজনীতির সাথে জড়িত এক প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, ‘হলিক্রিসেন্ট যদি চমেক হাসপাতালের ইউনিট হিসেবে চালু করতে হয় তবে চমেকেই কেন আলাদা ইউনিট নয়? চমেক হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক আর্মির ফিল্ড হাসপাতাল পরিচালনা করেছেন খুবই দক্ষতার সাথে। সরকার চাইলে তাকে কাজে লাগিয়ে চমেকের ক্যাম্পাসেই আলাদা করোনা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এক্ষেত্রে হলিক্রিসেন্ট সেই কোটিপতিদের জন্যই থেকে যাওয়া ছাড়া বিকল্প দেখছি না।’
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সরকারি দুটি হাসপাতালে কার্যক্রম চলছে। একটি আন্দরকিল্লাস্থ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, অপরটি ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতাল। ২৫০ শয্যার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ১০০টি, বিআইটিআইডি হাসপাতালের ৫০টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে জেনারেল হাসপাতালে ভেন্টিলেটরসহ ১০টি আইসিইউ শয্যাও স্থাপন করা হয়েছে।
সিপি