চট্টগ্রামে করোনায় বদলে গেল গৃহকর্মীনির্ভর মধ্যবিত্তের লাইফস্টাইল
অনেক পরিবারই গৃহকর্মী ছাড়া চলতে অভ্যস্থ হয়েছেন
চট্টগ্রাম নগরীর কুসুমবাগ এলাকার ভাড়া বাসায় স্বামী সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে থাকেন সুলতানা নাসরিন। স্বামী ব্যাংকে চাকরি করেন। তিনিও পরিবার দেখাশোনার পাশাপাশি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে নিজের রান্না করা খাবার বিক্রি করেন। নাসরিন বললেন, ‘লকডাউনের আগের জীবন যেমন যান্ত্রিক ব্যস্ততায় কাটত, এখন সময়টা তেমন নয়। সবাই বাসাতেই আছে। স্কুল- কোচিং বা প্রাইভেটের তাড়া নেই। বাসার কাজগুলোও সবাই মিলে করছি। ভালোই লাগছে। আর্থিক বিপদে এখনও পড়িনি। তবে ভবিষ্যতে কেমন সময় আসছে— সেটা ভেবে এখন আর গৃহকর্মী রাখিনি। তরকারি কেটে কুটে দেওয়া, বাচ্চাদের পড়ানো ও আমি খাবারের অর্ডার পেলে তার বাজার করা ও ডেলিভারির কাজটি স্বামী খুব আনন্দ নিয়েই করে দিয়েছেন। আসলে সবাই মিলে কাজ করলে কোন কাজই কঠিন নয়। বরং লকডাউনে স্বামীর চেয়ে আমিই বেশি ব্যস্ত থেকেছি তৈরি খাবারের অর্ডার নিয়ে। অবশ্য সবার ক্ষেত্রেই এরকম হবে— তা নয়।’
চট্টগ্রামসহ সারা দেশে করোনা লকডাউনের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর বেশিরভাগই অন্তত তিন মাস ধরে সংসার চালাতে বাধ্য হয়েছে গৃহকর্মীর সাহায্য ছাড়াই। শুরুতে কষ্ট হলেও অনেকেই এখন এই ‘কাজের লোক’ছাড়া জীবনেই বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
দীর্ঘ লকডাউনে বাড়ির রান্নাবান্না, বাসন মাজা বা ঘর ঝাড়ামোছার কাজে গৃহকর্মীদের সাহায্য পাওয়ার কোনও রাস্তা ছিল না। এই পরিস্থিতিই মধ্যবিত্ত সংসারের কর্ত্রীদের নতুন এক জীবনধারায় অভ্যস্ত করে তুলেছে।
নগরের দৈনন্দিন জীবন মানে নয়টা-পাঁচটা অফিস, সন্তানদের স্কুল-কোচিং এসবের সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকা। একটু ফুরসতে কোথাও ঘুরতে যাওয়া ছাড়া কোন অবকাশ থাকে না নাগরিক জীবনে। দৈনন্দিন ব্যস্ত সময়ে ঘরের কাজে সাহায্যের জন্য খুব প্রয়োজনীয় মানুষ হয়ে উঠেছে গৃহকর্মীরা। করোনার লকডাউনে এই গৃহকর্মীরা রয়েছেন ছুটিতে। তিনমাসেরও বেশি সময় ধরে গৃহকর্মী ছাড়াই কাটাতে হয়েছে নগরীর বেশিরভাগ পরিবারকেই। এ সময়ে অনেকেই স্বামী-স্ত্রী মিলে কাজ করে ঘর সামলাতে অভ্যস্ততা গড়েছেন। দৃঢ় হয়েছে দাম্পত্য বন্ধন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো ঘটনা। লকডাউনের সময়ে বাসার কাজ করতে হয়েছে একা নারীকেই। স্বামীর সাহায্য তো পাননিই, বরং সারাদিন বাসায় থাকায় পারিবারিক কলহ বেড়েছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় চাহিদার ভিত্তিতে ‘গৃহকর্মী’ কিছু দরিদ্র নারীর প্রধান পেশা হয়ে উঠেছে। গৃহশ্রমকে পেশা হিসেবে নিয়ে সেই আয় তারা নিজেদের সংসার চালাতে ব্যয় করেন। অন্যদিকে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলোতে প্রয়োজনেভেদে এক বা একাধিক গৃহকর্মী রাখা হয়। এ গৃহকর্মীরা কোথাও ঘণ্টা ও কোথাও কাজের পরিমাণের ভিত্তিতে পারিশ্রমিক নেন। এছাড়াও অনেকের বাসাবাড়িতে রয়েছে আবাসিক গৃহকর্মীও। চট্টগ্রাম নগরে বাসাবাড়িতে ‘ছুটা বুয়া’ হিসেবে কাজ করা গৃহকর্মীর সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি। তারা নিজেরা নগরের বিভিন্ন বস্তির কাঁচাঘর বা সেমিপাকা ঘরের একটি বা দুটি কক্ষ ভাড়া বসবাস করেন। এ পরিবারগুলোর আয়ের প্রধান উৎসই হল বাসাবাড়িতে কাজ করা।
এদিকে লকডাউন শিথিলের পর কেউ কেউ গৃহকর্মীদের কাজে পুনর্বহাল করলেও অনেক গৃহিণীই এখন বলছেন, ঘরের কাজ নিজেরাই মিলেমিশে সামলাতে পারছেন। গৃহকর্মীদের ওপর আর নির্ভরশীল হতে চান না। এছাড়া লকডাউনে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েও অনেকে গৃহকর্মী রাখতে পারছেন না। অনেক পরিবার আবার লকডাউন শিথিল হওয়ার পরই গৃহকর্মীদের পুনরায় কাজ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ঠিকভাবে সামলাতে গেলে সংসারে অনেক কাজ। ছেলেমেয়ের স্কুল বন্ধ হলেও তাদের হোমওয়ার্ক, ঘরের রান্না, পরিচ্ছন্নতার কাজ মিলে রীতিমত একটি যজ্ঞ। সাহায্যকারী ছাড়া নগরজীবন একেবারেই অসম্ভব।
গৃহিণী মেহরাজ আকতার বলেন, ‘আসলে কি জানেন, গৃহকর্মীদের কাজ কখনোই ঘরের মানুষের মত হয় না। তবু ব্যস্ততার কারণে রাখতে হতো। যতো ব্যস্ততা আসলে বাচ্চাকে নিয়েই। বাচ্চাকে স্কুল দিয়ে আসা ও নিয়ে আসার সময়ে যানজটের কারণেও ঘরের কাজে সময় পেতাম না। এখন নৈমিত্তিক কাজ সেরে কিছু শখের কাজ করারও সময় পাচ্ছি। এখন আমি গৃহকর্মী রাখার বদলে বাসায় ওয়াশিং মেশিন ও ওভেন কেনার কথা ভাবছি। যন্ত্রগুলো আসলে সময় বাঁচিয়ে দেয়।’
অবশ্য অনেকেই তার উল্টো চিত্রও দেখিয়েছেন। কয়েকজন নারী চিকিৎসকসহ পেশাজীবী বেশ কয়েকজন বিবাহিত নারী বলেছেন, করোনার সময়েও তাদের অফিস করতে হয়েছে। অথচ বাসার গৃহকর্মীও তখনও ছুটিতে। রান্নাবান্না তো আছেই। করোনা পরিস্থিতিতে ঘর ঠিকভাবে পরিচ্ছন্ন রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হওয়ায় তাদের দেখাশোনা করার বাড়তি দায়িত্বটুকুও নিতে হয়েছে। অফিসের পাশাপাশি বাসার কাজ ও পরিবারকে সময় দেওয়ার দায়টা বেশি নিতে হয় আমাদেরই। সুতরাং ভবিষ্যতেও গৃহকর্মী রাখবেন না— এভাবে তারা ভাবতে পারছেন না।
৬০ বছর বয়সী দিল আফরোজ বেগম। স্বামী মারা গেছেন ৫ বছর আগে। স্বামী বাড়ি করে দিয়েছিলেন খুলশীর পাহাড়তলীতে। দুই ছেলে প্রবাসী। ছেলের বউ ও নাতি-নাতনি নিয়ে তার মোটামুটি বড় পরিবারই। বাসার কাজের জন্য ছিল তিনজন গৃহকর্মী ও দারোয়ান। লকডাউনে দারোয়ানকে কাজে রাখলেও তিন গৃহকর্মীকে দিয়েছেন ছুটি। তিনি বললেন, ‘লকডাউনে বাসার সিঁড়ি মোছাসহ বিভিন্ন কাজ নিয়ে ঝামেলায় পড়েছি। রান্না-বান্না কোনমতে সামলে ফেলা যায়। কিন্তু সব কাজ গুছিয়ে সময়মত পেতে হলে এক-দুজন সাহায্যকারী প্রয়োজনই। রান্নায় সাহায্য না করলেও বাচ্চাদের সামলানোর কাজ করতে হচ্ছে ছেলের বউদের। মিলেমিশে কাজ করছি। প্রথম কিছুদিন উৎসব-উৎসব লাগলেও এখন হাঁপিয়ে উঠেছি। আবার গৃহকর্মীদের আসতেও বলতে পারছি না করোনার ভয়ে।’
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাশ করে চট্টগ্রামের একটি বায়িং হাউজে চাকরি করেন ফারহানা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘করোনায় আমি গৃহকর্মীকে শুধু এক সপ্তাহের ছুটি দিয়েছিলাম। এরপর তাকে বাসাতেই রেখে দিয়েছি। ঘরের কাজ ও অফিস— একই সাথে ব্যালেন্স করা যথেষ্টই কষ্টসাধ্য। এছাড়া সময়ও কই! আবার অফিস থেকে ফিরে সবকিছু ঠিকঠাক পেতে ইচ্ছে করে। তবে একটা কথা বলতেই হয় পুরোপুরি গৃহকর্মীনির্ভর হওয়া ঠিক নয়।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের বয়স সাত। ছেলেকে আমি নিজের রুম গোছানো, কাপড় কাঁচা একটু একটু শেখাচ্ছি। নিজের ক্ষেত্রেও ব্যাক্তিগত কাজগুলো নিজেই করার চেষ্টা করি। নিজের কাজ করতে পারা আত্মনির্ভরতার প্রথম ধাপ বা জীবন স্কিল বলতে পারেন। একসময় শ্রম এত সহজলভ্য থাকবে না। ঠিকই নিজের কাজ নিজে করতে অভ্যস্ত হতে হবে আমাদের।’
সিপি