চট্টগ্রামে দুঃসময়ের করোনাযোদ্ধাদের শূন্য হাত, মেলেনি সম্মানটুকুও

খাবারটিও কষ্টে জোগাড় করে নিতে হয়

চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষার প্রধান যে ল্যাব গত নয় মাসে হাজার হাজার মানুষের নির্ভুল রিপোর্ট দিতে দিনরাত অমানবিক শ্রম দিয়ে চলেছে, সেই করোনাযোদ্ধাদের ভাগ্যে জোটেনি সামান্য সম্মানও। সেখানে মাসের পর মাস যারা স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন, আর্থিক সম্মানী তো দূরের, সামান্য বরাদ্দ পাওয়া তো কষ্টকল্পনাই— যেখানে কাজের ফাঁকে খাবারটিও তাদের কষ্টে জোগাড় করে নিতে হয়।

চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণের শুরুতে যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক, তখন নির্ভয়ে এগিয়ে এসেছিল চট্টগ্রামের বিশেষায়িত হাসপাতাল বিআইটিআইডি। অল্প যন্ত্রপাতি, সামান্য লোকবল— এইটুকু সঙ্গী করে চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষায় এগিয়ে আসে এই প্রতিষ্ঠানটি। লোকবলের অভাব মেটাতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সেখানে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীও। করোনাকালে ভূমিকার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের অনেকেই করোনা বীর হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। পাচ্ছেন বিভিন্ন সম্মাননাও। অথচ শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আড়ালেই রয়ে গেছেন বিআইটিআইডির করোনাযোদ্ধারা। কতো জায়গায় হোটেল বিলেই উড়েছে কোটি টাকা, উল্টো পিঠে চট্টগ্রামের প্রকৃত এই করোনাযোদ্ধারা এমনকি খাওয়ার জন্যও একটি টাকা বরাদ্দ পাননি।

করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে করোনা মোকাবেলায় বেশি বেশি পরীক্ষা করানোকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মতামত দিচ্ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সে সময়ে একেবারেই সীমিত সক্ষমতা নিয়ে চট্টগ্রামে করোনা টেস্ট শুরু করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি)। বিআইটিআইডির পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে করোনা নমুনা পরীক্ষায় এগিয়ে আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী।

করোনাকালে সরকারের নানা প্রণোদনা বরাদ্দের মধ্যেও কঠিন আতঙ্কের সেই সময়ে ভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া সেই যোদ্ধাদের কপালে জোটেনি কিছুই। করোনা ল্যাবে স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া চবির সেসব শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম কোনো আর্থিক সম্মানী দেওয়া তো দূরে থাক, এই নয় মাসে তাদের খাওয়াদাওয়ার জন্যও সরকার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা এই করোনাযোদ্ধাদের খাওয়াদাওয়াটাও মেটাতে হচ্ছে নিজেদের মত করে।

করোনাকালে ভূমিকার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের অনেকেই করোনা বীর হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। পাচ্ছেন বিভিন্ন সম্মাননাও। এক্ষেত্রে আড়ালেই রয়ে গেছেন বিআইটিআইডির এসব নেপথ্যের করোনাযোদ্ধারা।

টানা নয় মাস ধরে বিআইটিআইডির ল্যাবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহবুবুল মাওলা। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমরা তো স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছি। ৯ মাস ধরে আছি এখানে। হালিশহর থেকে সাইকেল চালিয়ে ফৌজদারহাট গিয়ে ল্যাবে কাজ করে আবার ফিরে আসি। এটার বিনিময়ে অবশ্য কিছু পাব এমনটা আশা করি না। মানবিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই আমরা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে কাজে লাগাতে চেয়েছি।’

‘তবে গত মাস থেকে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে আট হাজার টাকা করে সম্মানী দেওয়া হচ্ছে আমাদের। এটি আগামী ছয় মাস দেওয়া হবে’— বলেন মাহবুবুল মাওলা।

বিআইটিআইডি ল্যাবের প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কঠিন সেই সময়ে যেসব শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে এসেছে তাদের একটু সম্মানিতও করা যায়নি। এটা আমারও খারাপ লেগেছে। আমি বেশ কয়েক জায়গায় কথা বলেছি।’

তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে তো তাদের আসা-যাওয়াটাও বিরাট সমস্যা ছিল। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটা মাইক্রোবাস দেওয়া হলো। শুরুর দিকে আমাদের খাওয়াদাওয়ারও সমস্যা ছিল। সামনে কিছু ঝুপড়ি আছে। সেখান থেকে খাবার এনে খেতাম। পরে হাসপাতালে যেহেতু রান্নার ব্যবস্থা আছে, আমি সেখানেই খাবার রান্না করতে বলি। এই খরচটাও এখন পর্যন্ত নিজের পকেট থেকে দিচ্ছি আমি। এর জন্য কোনো পর্যায় থেকে সামান্য বরাদ্দও আমরা পাইনি।’

এই বিষয়ে নিজের হতাশার কথা তুলে ধরে ডা. শাকিল বলেন, ‘আমাদের এখানে সরকারি স্টাফ যারা আছি, তারা সরকারি বেতন পাচ্ছি। সেটা ৮ ঘন্টার। কিন্তু গত ৯ মাস ধরে এদের কোন ছুটিছাটা নাই। দিনে ১২-১৪ ঘন্টা ধরে একটানা কাজ করে। এর মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকরা তো কিছুই পাচ্ছে না। অথচ আমাদের ল্যাবে প্রবাসীদের নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে। এই নমুনা থেকেই কোটি কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হচ্ছে। তাহলে এখানে যারা কাজ করছে, তাদের মূল্যায়ন করতে কোনো উদ্যোগ নেই কেন— সেটা আমি বুঝতে পারি না।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। আপনি বরং বিআইটিআইডির পরিচালকের সাথে কথা বলুন।’

এক্ষেত্রে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কোনো দায়িত্ব কি নেই— এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা সিভিল সার্জন বলেন, ‘আমরা আমাদের মত করে বিভিন্ন জায়গায় বলেছি। কিন্তু ডাক্তাররাই এখনও কোনো প্রণোদনা পাননি। এই বিষয়ে আর কী বলবো?’

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতা ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘এটি আসলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল। সব হাসপাতালেই একাধিকবার থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিআইটিআইডিতেও কয়েক দফায় থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই ল্যাবেও একটা অংশ খরচ করা যেত।’

এই বিষয়ে কথা বলতে দুই দফায় বিআইটিআইডির পরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ হাসান চৌধুরীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য জানা যায়নি।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!