চট্টগ্রামে ওষুধের মান পরীক্ষার ল্যাবে ৬ বছরে ১৮ টেস্ট, কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি হেলায় অকেজো
কেনা হচ্ছে আরও পৌনে ৪ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি
প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও সেই অনুযায়ী ওষুধের নমুনা পরীক্ষা হয় না চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবে। গত ছয় বছরে ল্যাবটিতে মাত্র ১৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অপ্রতুল লোকবল ও পরিচর্যার অভাবে যন্ত্রপাতিগুলোও অকেজো পড়ে আছে। এর মধ্যে নতুন বরাদ্দে আরও প্রায় ৩ কোটি ৭৯ লাখ যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। অথচ ২০২৫ সালের মধ্যে চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিকমানের গড়ে তোলার নির্দেশনা এসেছে ঢাকার ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি থেকে।
জানা যায়, স্বাধীনতার পরপরই আঞ্চলিক ল্যাবরেটরি হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। ১৯৯৭ সালের পর এটির নাম দেয়া হয় চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি। এরপর এখানে নতুন কোনো পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ২০১২ সালের ২০ জুন ল্যাবে উপপরিচালক পদে দায়িত্ব পান মুশফিকুর রহমান। ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই তিনি চলে যাওয়ার পর আবারও বন্ধ হয়ে যায় এলোপ্যাথিক ওষুধের নমুনা পরীক্ষা। এর পাঁচ বছর পর ২০২১ সালের এপ্রিলে উপপরিচালক পদে দায়িত্ব নেন মো. কাইয়ূম। এর আগে ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই ল্যাবরেটরির জীবাণুবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মো. কাইয়ূম দায়িত্ব নেয়ার পর ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৮টি নমুনা পরীক্ষা হয় চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে। এর আগে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত একটি নমুনাও পরীক্ষা হয়নি এ ল্যাবে। ওই নমুনা পরীক্ষায় জেনিথ, কোয়ালিটি, আলবিন, ইবনে সিনা, জেসন, বায়োফারমা. ফারমিকসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির ওষুধ পরীক্ষা করা হলেও কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়নি। তবে হোমিও এবং আয়ুর্বেদিকের ২টি নমুনায় সাব-স্ট্যান্ডার্ড (ভেজাল) পাওয়া যায়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে সেন্ট্রাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠানটি শুধু নামেই আছে। অফিসের গুদামঘরে পড়ে আছে ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি। এই ল্যাবরেটরিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো। নতুন যেসব মেশিন কেনা হচ্ছে তা অফিসের দ্বিতীয় তলায় রাখার কথা রয়েছে। সেখানেও তাপ এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। সেইসঙ্গে অপ্রতুল জনবল দিয়ে কোনোমতে চলছে ল্যাবরেটরি। এছাড়া আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল সংলগ্ন এই ল্যাবটির নিচতলা দিনের বেলা প্রায় সময় ডুবে থাকে জোয়ারের পানিতে।
নিয়ম অনুযায়ী যত ওষুধ আমদানি ও রপ্তানি হবে এবং যেসব ওষুধ বাজারে আছে সেসব ওষুধের গুণগতমান ঠিক আছে কিনা তা নিশ্চিত করা ঢাকা ও চট্টগ্রাম ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির কাজ। দেশে আমদানি করা ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল এই দুই ল্যাব থেকে চূড়ান্ত পরীক্ষার পর বাজারে ছাড়া হয়। তবে মাঠ পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ করার দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। ঢাকার ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি থেকে কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অর্থাৎ যেসব ওষুধ মার্কেটে চালু আছে তা পরিদর্শন করে গুণগতমান নিয়ে সন্দেহ হলে তার নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠাবেন ড্রাগ সুপার। ওষুধ প্রশাসনের ফিল্ড অফিসাররা প্রতিমাসে ৩০টি নমুনা ড্রাগ টেস্টিং এর জন্য পাঠাবেন। দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পারফরম্যান্স রিপোর্ট দিতে হবে। আর এ পারফরম্যান্স রিপোর্ট দেখতে ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিপ্রধান ৩ মাস পরপর চট্টগ্রামের ল্যাব পরিদর্শন করতে আসবেন।
এদিকে গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকার অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির জন্য। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ মিলেছে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া আরও প্রায় ৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকার নতুন যন্ত্রপাতিও কেনা হচ্ছে ল্যাবের জন্য। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল পৌনে ২ কোটি টাকা।
২০২১-২২ সালের নতুন বরাদ্দকৃত বাজেটে দেখা গেছে, কর্মকর্তার মূল বেতন বাবদ ধরা হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা, কর্মচারীর মূল বেতন ৩৯ লাখ টাকা, দায়িত্ব ভাতা ৫০ হাজার টাকা, যাতায়াত ভাতা ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, শিক্ষাভাতা ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, বাড়িভাড়া ভাতা ২৬ লাখ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬ লাখ টাকা, টিফিন ভাতা ৬০ হাজার টাকা, ধোলাই ভাতা ১০ হাজার টাকা, উৎসব ভাতা ১৪ লাখ টাকা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা ২ লাখ টাকা, বাংলা নববর্ষ ভাতা ২ লাখ টাকা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ ২ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৪ লাখ টাকা, পানির বিল বাবদ ১০ লাখ টাকা (২০২০-২১ অর্থবছরে পানির বিল ৪ লাখ ৫০ হাজার বকেয়া রয়েছে), ইন্টারনেট বিল ৩০ হাজার টাকা, পেট্রোল, ওয়েল, লুব্রিকেন্ট ৩ লাখ টাকা; টেলিফোন ৩০ হাজার টাকা, গ্যাস, জ্বালানি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ভ্রমণ ব্যয় ৫০ হাজার টাকা, কম্পিউটারসামগ্রী ২ লাখ টাকা, অনান্য মনিহারি ৫ লাখ টাকা, পৌরকর ৩৭ লাখ টাকা (২০২০-২১ অর্থবছরে ১৬ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে)।
চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির উপপরিচালক মো. কাইয়ূম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব এই পরিবেশে সম্ভব না। শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক কেমিক্যাল টেস্ট করা যাবে এখানে। স্যালাইন, ইনজেকশন, জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিক রিলেটেড স্যাম্পলগুলো পরীক্ষা করাতে বায়োলোজিক্যাল ল্যাবের দরকার হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় এসব নমুনার টেস্ট করতে হয়।
নতুন কেনা যন্ত্রপাতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকার মেশিন চালাতে বিদ্যুৎ সাবস্টেশন বসাতে হবে। কারণ এখানে দরকার ২২০ ভোল্ট, আছে ১৬০ ভোল্ট। এজন্য পিডিবিকে চিঠি দেয়া হয়েছে। পিডিবি ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকার বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এছাড়া নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
লোকবল সংকট নিয়ে মো. কাইয়ূম বলেন, নতুন মেশিন আসলেও এখানে রয়েছে লোকবল সংকট। ৪৬ জনের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ১৩ জন। অন্যদিকে এখানে কর্মরত হলেও ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে সংযুক্ত হয়ে ঢাকায় আছেন ১০ জন। কারণ এখানে নমুনা পরীক্ষা না হওয়ায় তাদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
ডিজে