শেখ হাসিনার কর্মপ্রচেষ্টা গণমুখী ও নিখুঁত হলেও জেলা উপজেলা পর্যায়ে তার সুফল মানুষ পাচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন প্রান্তিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করায় দল ও দলের নেতৃত্বের ব্যর্থতা রয়েছে উল্লেখ করে আগামী এক বছরের মধ্যে ভুলভ্রান্তিগুলো উপলব্ধি করে সেগুলো সংশোধনের তাগিদও দেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান এই নেতা। পাশাপাশি বিএনপির সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় সাংগঠনিক রাজনীতিতে হাতিয়ার করতেও এ সময় পরামর্শ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাবেক গণপরিষদ সদস্য এম আবু ছালেহর শোকসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে এসব কথা বলেন আমির হোসেন আমু। এই শোক সভার আয়োজন করে যৌথভাবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা, দক্ষিণ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ।
শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহরে এলজিইডি মিলনায়তনে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই শোকসভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান আতা, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান প্রমুখ।
শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেও আওয়ামী লীগ তার সুফল ঘরে তুলতে পারছে কিনা— এই প্রশ্ন তুলে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আমরা যে যত কথাই বলি না কেন আমাদের বুঝতে হবে শেখ হাসিনা তার কর্ম প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আজকে শুধু বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। এই যে তার কর্মকাণ্ড এর কতখানি সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারছি তা কি আমরা হিসেব করতে পারছি? যদি পারি তাহলে নির্বাচন নিয়ে আমাদের প্রশ্ন থাকবে কেন? তাহলে আমাদের ভুলভ্রান্তিটা কোথায় তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।’
শেখ হাসিনার নেওয়া কর্মসূচিগুলো জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সঠিকভাবে পরিবেশন করা যাচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলে আমু বলেন, ‘আজকে তিনি যা প্রচেষ্টা নিচ্ছেন… তিনি যে চাল দিচ্ছেন, ত্রাণ দিচ্ছেন, টিসিবির মাধ্যমে সহযোগিতা দিচ্ছেন এগুলো যদি সঠিকভাবে পরিবেশন না করি তাহলে এর কোন সুফল আওয়ামী লীগের ঘরে যাবে না। এটা হলো বাস্তবতা। এখন আমরা শুধু উনার কাজের প্রশংসা করবো। কিন্তু উনার কাজগুলো জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রতিফলনে আমরা যদি সৎভাবে কাজ না করি তাহলে তো রেজাল্ট জিরো। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে উনি যেসব কর্মসূচি দিচ্ছেন সেগুলো ঠিকভাবে মানুষ পাচ্ছে কিনা? যদি এসব সেবা মানুষ ঠিকভাবে না পায় তাহলে যতই উন্নয়নের কথা বলি না কেন রেজাল্ট ঘরে আনা যাবে না। এই বাস্তবতাটা আমাদের সবার মনে রাখতে হবে সবাই উপলব্ধি করতে হবে।’
স্থানীয় পর্যায়ে নেতাদের দুর্নীতি ও পেশীশক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ার মানসিকতা থাকলে শেখ হাসিনার ভালো কাজের রেজাল্ট শূন্য হবে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, ‘আজকে উনি যতোই ভালো কাজ করুক কিন্তু আমার এলাকায় আমার কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করবে আমার দল ভোট পাবে কি পাবে না। শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারা আমার এলাকায় প্রতিফলিত হবে না যদি না আমি সঠিকভাবে আমার এলাকায় কাজ করি। আমি আমার এলাকায় যদি অত্যাচার করি, আমি আমার এলাকায় যদি অন্যায় করি আমি যদি সমস্ত কাজের বিনিময়ে পয়সা নিই, আমি যদি সব কাজে দুর্নীতি করি, দুর্নীতি পেশীশক্তিকে প্রশ্রয় দিই তাহলে কিছুতেই শেখ হাসিনার প্রচেষ্টার সফলতা আসবে না। এই বাস্তবতাটা মনে রেখে সংগঠন গোছাতে হবে। মাত্র এক বছর সময় আছে এর মধ্যে যদি আমাদের কোন ভুলত্রুটি থাকে তাহলে সেগুলো সংশোধন করে এগিয়ে যেতে হবে।’
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর সংঘাত ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এড়াতে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে বিজয় মিছিল পর্যন্ত করতে দেননি— এমন কথা জানিয়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য আমু বলেন, ‘৯৬ সালে আমরা ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো ২১ দিনব্যাপী আমরা বিজয় উৎসব করবো। কিন্তু শেখ হাসিনা বললেন, বিজয় উৎসব তো বাদ, বিজয় মিছিলও করা যাবে না। কারণ উনি মনে করেছিলেন যেহেতু আমরা ২১ বছর ধরে অত্যাচারিত হয়েছি সেই অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে যদি আমাদের বিজয় মিছিল থেকে কেউ বিএনপির বাড়িতে আগুন দেয়-আক্রমণ করে তাহলে একটা বিশৃংখলা হবে। এটি উনি নিতে চাননি। এই কারণে তিনি আমাদের বিজয় মিছিলও করতে দেননি।’
তবে এর প্রতিদানে ২০০১ সালে বিএনপির কাছ থেকে যে তিক্ত প্রতিদান পেতে হয়েছিলো সেটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমু বলেন, ‘কিন্তু তার প্রতিদানে আমরা কী পেয়েছিলাম! ২০০১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসলো তখন আমাদের অঙ্গ সংগঠন সহযোগী সংগঠন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ ৩৩ হাজার লোককে তারা হত্যা করেছিলো। তারা ঘরে ঘরে আগুন দিয়েছিল। আজকে যখন তারা মানবতার কথা বলে, তাদের ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অথচ ২১ বছর অত্যাচারিত হওয়ার পর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমরা কিন্তু তাদের নেতাকর্মীদের একটি ফুলের ঠোকাও দেইনি। তাদের ঘোষণা ছিলো ২০০৬ সালে যদি তারা আবার ক্ষমতায় আসতো আমাদের দেড় লক্ষ লোকের তালিকা তারা করেছিলো যাদের তারা হত্যা করতো। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার।’
তবু বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার পরামর্শ দিয়ে এবং সেটি করতে না পারায় দল এবং দলের নেতাদের ব্যর্থতার বিষয়ে সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা বলেন, ‘আজকে সেই রাজনীতিকে যদি আমাদের মোকাবেলা করতে হয় প্রতিহত করতে করতে হয়, তাহলে সেটা রাজনৈতিকভাবে করতে হবে। রাজনীতির হাতিয়ার শেখ হাসিনা আমাদের দিনের পর দিন তুলে দিচ্ছেন তার কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে, আমরা এগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারবো কিনা সেটা নির্ভর করছে কর্মীদের ওপর। সেটা করতে পারলে আমাদের ভোটের চিন্তা করতে হবে না। আজকে সেজন্য আবু ছালেহর মত নেতার প্রয়োজন ছিল। যাদের কারণে বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছিলেন, আজকে শেখ হাসিনা কেন সে জায়গায় যেতে পারবেন না? আজকে শেখ হাসিনা যখন বিশ্ব দরবারে সমাদৃত, তখন তাকে নিজ দেশে কেন এত চিন্তা করতে হবে? এটা ভাববার ব্যাপার। এটা আমাদের দলের ব্যর্থতা, আমাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা, আমাদের কর্মের ত্রুটি।’
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাবেক গণপরিষদ সদস্য এম আবু ছালেহ প্রসঙ্গে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘তিনি নেতা নন, নীতির প্রতি কমিটেড ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি অনুগত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করায় তার সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আমরা একসাথে রাজনীতি করেছি। একসাথে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে কাজ করেছি।’
সিপি