চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজিতে ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। ইংরেজিতেই ফেল করেছে ৩২ হাজার ৭৯৪ জন পরীক্ষার্থী। একইসঙ্গে তথ্য, যোগাযোগ প্রযুক্তি ও যুক্তিবিদ্যায়ও ফলাফল খারাপ হয়েছে। ফলে ইংরেজির কারণে পরীক্ষার্থীদের সামগ্রিক ফলাফলে প্রভাব পড়েছে, কমেছে পাসের হার। তথ্য, যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এবং যুক্তিবিদ্যার ফলাফল খারাপ হওয়ায় মানবিক বিভাগের পাসের হারে এর প্রভাব পড়েছে।
ইংরেজিতে পাসের হার কম হওয়ার পেছনে ইংরেজি ভীতি, দক্ষ শিক্ষকের অভাব, পরীক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস না করা, গোড়া থেকে ইংরেজির ভিত মজবুত না হওয়াকেই দায়ী করেছেন খোদ ইংরেজির শিক্ষকরা।
কিন্তু পরীক্ষার্থীদের দাবি, ইংরেজি ২য় পত্রের প্রশ্ন কঠিন হওয়ায় ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে।
চট্টগ্রাম বোর্ডে এবার পাসের হার ৭০ দশমিক ৩২ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এবার বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৯১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, মানবিকে ৫৭ দশমিক ১১ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পাসের হার ৭৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১০ হাজার ২৬৯ জন, গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৩৩৯ জন।
পাসের হার কমলেও জিপিএ-৫ বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এএমএম মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিকে পাসের হার মূলত নির্ভর করেছে বাংলা, ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের ওপর। এ পরীক্ষাগুলো হয়েছে পূর্ণ নম্বরে। যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছিল, সেগুলোর ফলাফল উচ্চ মাধ্যমিকে গড় পাসের হারে বড় রকমের প্রভাব ফেলেনি।’
জিপিএ–৫ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিষয় ম্যাপিং বড় নিয়ামক বলেও জানান এ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
তিনি আরও বলেন, ‘এবারের পাসের হার কমে যাওয়ার পেছনে মানবিকে ফল বিপর্যয়ও দায়ী। যেখানে বিজ্ঞানে পাসের হার ৯১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, সেখানে মানবিকে ৫৭ দশমিক ১১ শতাংশ। আর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পাসের হার ৭৩ দশমিক ৫২ শতাংশ।’
এছাড়া ইংরেজি ভীতি বরাবরের মতো পরীক্ষার্থীদের কাবু করেছে। এর সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও পরীক্ষার্থীদের মনে বড় প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন এএমএম মুজিবুর রহমান।
এদিকে বিষয়ভিত্তিক পাসের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলায় পাস করেছে ৯০ দশমিক ৪১ শতাংশ, ইংরেজিতে ৬৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, আইসিটিতে ৮৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যুক্তিবিদ্যায় ৮৩ দশমিক ২১ শতাংশ।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি ২য় পত্রের প্রশ্নে এক নম্বরে ছিল ৫ নম্বর মানের প্রিপজিশন। কিন্তু পরীক্ষার্থীদের প্রিপজিশন চর্চায় ভুল ছিল বলে দাবি করছেন ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানকারী শিক্ষকরা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইয়াছিন আরাফাত খান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিবছর এইচএসসির ইংরেজির খাতা দেখতে গিয়ে আমার বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা হয়। এক শ্রেণির পরীক্ষার্থীর থাকে জ্ঞানের অভাব। আরেক শ্রেণির পরীক্ষার্থীর থাকে ওভার কনফিডেন্ট। তাদের ধারনা, তারা সবকিছুই পারেন। যার প্রভাব পড়ে উত্তরপত্রে। ওভার কনফিডেন্টের কারণে প্রিপজিশন চর্চা করে না পরীক্ষার্থীরা।
ইয়াছিন আরাফাত বলেন, ‘মফস্বলের পরীক্ষার্থীদের খাতা দেখতে গিয়ে মনে হয়, কোনোভাবেই ইংরেজি বিষয়ে তাদের সংম্পর্শ নেই, খাতায় প্রেজেন্টেশন নেই। কিভাবে লিখবে, তাও তাদের জানা নেই। মূলত মফস্বলে কলেজগুলোতে দক্ষ ইংরেজি শিক্ষকের অভাব থাকায় এ অবস্থা হয়।
পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ নম্বর মানের suitable words /phrase তুলনামূলক সহজ ছিল। সহজ ছিল ১০ নম্বর মানের completing sentence।
পরীক্ষার্থীদের বুঝতে সমস্যা হয়েছে ৭ নম্বর মানের write form of verb। কারণ, এটিতে ৭ নম্বর মানের টেন্স অনুযায়ী সঠিক verb বসাতে পারেনি পরীক্ষার্থীরা। নাসরিন পলি নামে বাকলিয়া সরকারি কলেজের এক পরীক্ষার্থী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ টপিকটি জটিল ছিল। বুঝতে কষ্ট হয়েছে। ৭ নম্বরের মানের narration যেটি ছিল ইনডিরেক্ট থেকে ডিরেক্ট স্পিস করা, এটিও কঠিন লেগেছে পরীক্ষার্থীদের। আর নিয়মিত চর্চা না করায় এটি উত্তর দিতে পারেনি অনেক পরীক্ষার্থী। ৫ নম্বর মানের মডিফায়ার সহজ ছিল। এ প্রশ্নে খালি ঘরে হিন্টস দেওয়া থাকে। ওই অনুযায়ী শব্দ খালি ঘরে বসাতে হয়।
নাসরিন পলি আরও বলেন, ‘কিন্তু পরীক্ষার্থীরা ৭ নম্বর মানের কানেক্টর উত্তর দিতে পারেনি। কানেক্টরে fill in the blanks এ প্যাসেজ অনুযায়ী উপযুক্ত কানেক্টর বসাতে হয়।’
নাদিয়া নামে পটিয়া সরকারি কলেজের এক পরিক্ষার্থী বলেন, ‘এ টপিক (কানেক্টর) কঠিন ছিল। প্যাসেজ বুঝতে সমস্যা হয়েছে।’
আরও কয়েকজন পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৭ নম্বর মানের synonym or antonym এ ওয়ার্ড পরিচিত ছিল না, এজন্য পারেনি অনেকে। ৭ নম্বর মানের punctuation হল বাক্যে উপযুক্ত সুয়েটবল দাড়ি, কমা বসানো—যেটি সহজ ছিল। সবাই উত্তর দিতে পেরেছে। এ বিষয়ে মাহি নামে এক পরীক্ষার্থী বলেন, এ টপিকটি ইংরেজিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকিই ছিল, আমরা এতে অভ্যস্ত।’
মোবাশ্বেরা তাবাসসুম নামের এক পরীক্ষার্থী বলেন, ইংরেজি ২য় প্রশ্নপত্রে পরীক্ষার্থীদের বেশি ভুগিয়েছে পার্ট ‘বি’র ১০ নম্বর মানের অ্যাপ্লিকেশন। এটির বিষয়বস্তুতে জটিলতা ছিল। কোন বিষয়ে লিখতে বলেছে—সেটা বুঝা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা দ্বিতীয়পত্রে ১৫ নম্বর মানের প্যারাগ্রাফ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এসেছিল, তাই পরীক্ষার্থীরা ইংরেজিতে সেটি অনুশীলন করেনি। কিন্তু ইংরেজিতে একই বিষয়ে ২০০ শব্দের একটি প্যারাগ্রাফ লিখতে বলা হয়, যার মান ছিল ১০। পরীক্ষার্থী নিজের মতো করে লিখতে গিয়ে ভুল করেছে। ১৫ নম্বর মানের compare and contrast paragraph এ ছিল junk food and healthy food । এ দুটোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে লিখতে বলা হয়েছিল। এটিও লিখতে পারেনি অনেক পরীক্ষার্থী।’
ইংরেজি ২য় পত্রের এমন ফলাফলের কারণ হিসেবে গ্রামাটিক্যাল রুলস ও ভোকাবিলারিতে দুর্বলতাকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন ইংরেজির শিক্ষক ইয়াছিন আরাফাত খান। তিনি বলেন, ‘গ্রামাটিক্যাল রুলস মেনে ইংরেজি না শেখার কারণে এইচএসসিতে ইংরেজিতে এসে ধরা খায় পরীক্ষার্থীরা। পূর্ণাঙ্গ বাক্য ও স্ট্রাকচার জানতে হবে। কিন্তু না জেনে তারা ওপরের ক্লাসে ওঠে যায়। ন্যারেশনে তারা ছোট ছোট ভুল করে। পরীক্ষার্থীদের ওভারঅল টেন্স বুঝতে হবে। ইংরেজিতে ভোকাভোলারিতে ভালো না হলে শব্দের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বের করার সম্ভব না। আর মুখস্ত করে প্যারাগ্রাফ, এপ্লিকেশন লেখা সম্ভব না।
পরীক্ষার্থীদের দক্ষতা আনতে হলে কলেজমুখি হতে হবে। গ্রামাটিক্যাল রুলস জানতে হবে। প্রাথমিক থেকে পরীক্ষার্থীদের ইংরেজির গোঁড়া শক্ত করতে হবে। আর মফস্বলের অবস্থা করুণ, দক্ষ শিক্ষক না থাকায় সেখানকার পরীক্ষার্থীরা দিনের পর দিন ইংরেজি শেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করেন ইয়াছিন আরাফাত খান।
ডিজে