চট্টগ্রামে সংঘর্ষের ঘটনায় একদিনেই আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ২২০ জন। এদের বেশিরভাগই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত চারজনের অবস্থা খুবই গুরুতর। ছররা গুলিতে বিদ্ধ হয়েছে ১২ বছর বয়সী এক শিশুও। এছাড়া আহতদের মধ্যে রয়েছেন এক ছাত্রীও। আহত অনেকের শরীরে রয়েছে ধারালো ছুরির আঘাত।
এদিকে রোববার (৪ আগস্ট) রাত পৌনে নয়টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ও মুরাদপুর এলাকায় থেমে থেমে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। রাত সাড়ে ৮টার দিকে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় একদল অস্ত্রধারী অন্তত দুজনকে গুলি করেছে বলে স্থানীয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এর বিস্তারিত জানা যায়নি।
ঘটনাস্থল থেকে প্রত্যক্ষদর্শী চট্টগ্রাম প্রতিদিনের প্রতিবেদক জানান, বহদ্দারহাট এলাকায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ ক্রমাগত রাবার বুলেট ছুঁড়ে যাচ্ছে। ফিরতি জবাবে শিক্ষার্থীরা ঢিল ছুঁড়ে যাচ্ছিল। এতে কালুরঘাট শিল্পাঞ্চল থেকে কাজ শেষে বের হওয়া গার্মেন্টসশ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি করতে থাকেন।
এদিকে নগরীর আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকায়ও বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-নেতাকর্মীদের বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ চলার খবর পাওয়া গেছে। সেখানেও থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানিয়েছেন।
খবর নিয়ে জানা গেছে, রোববার (৪ আগস্ট) রাত আটটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ২০০ জন। এদের বেশিরভাগের শরীরেই গুলির আঘাত রয়েছে। অন্তত তিনজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তবে রাত ৮টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তছলিম উদ্দিন খান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আহত ব্যক্তির সংখ্যা ১৯০ ছাড়িয়ে গেছে।’ এর বাইরে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে।
এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১২ বছর বয়সী এক শিশু। তার নাম শাহাদাত হোসেন। ছররা গুলিতে বিদ্ধ এই শিশুকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রবিবার (৪ আগস্ট) সকাল থেকে সংঘর্ষের স্থান থেকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সদস্য ও আহত শিক্ষার্থীদের সহপাঠী ছাড়াও স্থানীয় লোকজন আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যান।
চট্টগ্রামে আহতদের একাংশ
চট্টগ্রামের সংঘর্ষে আহতদের নামের একাংশ পাওয়া চট্টগ্রাম মেডিকেল সূত্রে। নামগুলো হচ্ছে— এইচএসসি পরীক্ষার্থী সিফাত উদ্দিন, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন (২৬), শিক্ষার্থী মো. কলিম, অনিক, চিশতি, আশরাফুল, কাঞ্চন, মো. ফয়সাল (২৬), মাঈনউদ্দিন, কাওছার হোসেন (২৪), তরিকুল ইসলাম (২০), ফরহাদ (১৭), শাহীন (২৪), মাহবুব হোসেন (২৪), তরিকুল ইসলাম (২০), ফারহান (২৩), সাজিদুল হক (২৫), মো. ইসমাইল (১৮), অনিক (২৫), মাহমুদুর রহমান (২৫), ইমরান (২১), সুমন বিশ্বাস (২৫), সুজিত হোসেন (১৮), আবু রায়হান(১৮), রাফি (১৯), মুশফিক (১৯), তপু (২৬), ইমরান (১৯), আলভী (৩৬), সুচিত রোহান (১৮), তাহমিদুল ইসলাম (২৩)।
আহতদের মধ্যে আরও রয়েছেন—চাকরিজীবী মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন (২২), তাহসিন, আবদুল হালিম (৩১), মো. নাছির (৩৭), মারুফ (২৭), নয়ন (৩০), শুক্কুর (২০), জয়নাল আবেদীন (৩৬), আইনজীবী আবু তাহের (২৭) ও শরিফ (৩৫), রিকশাচালক মো. শিলা, সাজ্জাদ হোসেন (২৮), ইয়াছিন আরাফাত (২০), হাসান (২০), মাঈনউদ্দিন (২০), বাবু ((২০), মো. আসিফ( ১৭), সুজন (৩৫), মো. কবির (২৫), শাহেদ, সাইফুল (৩৫), রবিউল আউয়াল (২৯), ব্যবসায়ী মন্টি চৌধুরী (৩৮), আতিকুল ইসলাম (২০), মেকানিক বাদশা (২৩), মো. সোহরাব (৩৭), আকরাম (২৯), হাসনাত, আলমগীর, আরমান (৩২), হাসনাত (২৫), আকরাম, মুসফিক (১৮), আবরার হোসেন (৪০), আকবর হোসেন (৩০)।
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিও নিউমার্কেটে আহত হয়েছেন। অন্যদিকে আহতদের মধ্যে চট্টগ্রাম নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজসহ ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী রয়েছেন বলে জানা গেছে।
নিউ মার্কেট এলাকায় এ সময় কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন। এর মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনের নিজস্ব প্রতিবেদক রিমন সাখাওয়াৎ, দেশ রূপান্তরের ফটোসাংবাদিক আকমল হোসেন এবং ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক মিজানুর রহমান।
অস্ত্র হাতে সরকারিদলের নেতাকর্মীরা
সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল জামালখান মোড় থেকে কাজির দেউড়ি মোড় হয়ে আসকারদিঘির দিকে আসতেই সেখানে আগে থেকে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা এ সময় অনেকের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র দেখেছেন। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের পাশে হেলমেট পরিহিত এক যুবক প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হেঁটে যাচ্ছেন। ওই সময় আরও একজনকে কোমরে গুঁজে রাখা অস্ত্র বের করতে দেখা গেছে।
পুলিশের পাশাপাশি সরকারি সিটি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা মো. ফয়সালকে রিভলবার থেকে গুলি ছুঁড়তে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
সকাল থেকে শুরু
চট্টগ্রামের নিউমার্কেটে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষ গড়ায় কোতোয়ালী থানার পাশে মুসলিম হাই স্কুলের সামনের এলাকায়ও। আন্দোলনকারীরা কয়েকটি ভাগে বিভিন্ন দিকে সরে যাওয়ার পর দুপুরে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে নিউমার্কেট মোড়ে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ। নিউমার্কেটের সংঘর্ষে পুলিশের পাশাপাশি এক ছাত্রলীগ নেতাকে প্রকাশ্যে থেকে গুলি ছুঁড়তে দেখা গেছে। বিকেলে থেমে থেমে গুলি হতে থাকলে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সরে পড়েন আশেপাশে। ওই সময় সেখানে পুলিশের পাশাপাশি সেনাসদস্যরা অবস্থান নেন। এরপর রোববার (৪ আগস্ট) বিকেল ৫টার দিকে আবার চট্টগ্রাম নগরীর নিউমার্কেট চত্বরে অবস্থান নেন বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতার একাংশ।
এর আগে রোববার (৪ আগস্ট) সকাল ১০টার দিকে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা নিউমার্কেট এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও আশপাশে অবস্থান নিতে থাকেন। সকাল থেকেই পুরো এলাকা ছিল থমথমে। এ সময় বিপণিবিতানসহ কোনো দোকানপাট খোলা হয়নি।
সকাল ১১টার দিকে সিটি কলেজ ও কোতোয়ালী থানার দিক থেকে এসে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের দুটি দল। এরপর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। পুলিশ এ সময় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় থেমে থেমে গুলির শব্দও শোনা গেছে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর সড়কের বেশ কিছু ইটের টুকরো ও ভাঙা চৌকি পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
এর একপর্যায়ে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার বড় একটি অংশ স্টেশন রোড হয়ে টাইগারপাসের চলে যায়। অপর একটি অংশ নন্দনকানন পুলিশ প্লাজার দিকে চলে যায়। টাইগারপাস যাওয়ার সময় তারা রাস্তার পাশের দোকান ও একটি পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে। নিউমার্কেট মোড়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশের জন্য আনা মাইকও ভাঙচুর করেন আন্দোলনকারীরা। এছাড়া দারুল ফজল মার্কেটে আওয়ামী লীগের অফিসেও ভাঙচুর চালানো হয় বলে জানা গেছে।