চট্টগ্রামে আবার দুজন গুলিতে নিহত, ৭ গুলিবিদ্ধ, আহত অর্ধশতাধিক
চান্দগাঁও থানায় ভাঙচুর, পুলিশ বক্সে আগুন
চট্টগ্রামে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষে অন্তত দুজন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন কমপক্ষে সাতজন। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা খুবই গুরুতর। দুপুরে নগরীর জিইসি মোড়ে আন্দোলনকারী অমি নামের এক শিক্ষার্থীকেও কুপিয়েছে ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা। সংঘর্ষের ঘটনায় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। এদের মধ্যে ২২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিরা নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখার সময়ও বহদ্দারহাট এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষ চলছে।
নিহতদের দুজনই বহদ্দারহাটে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে একজনের নাম তানভীর বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি কলেজছাত্র। অন্যদিকে নিহত অপরজন বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ২২ বছর বয়সী ওই তরুণের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে গুলিবিদ্ধ সাতজন হলেন— ওমরগণি এমইএস কলেজের শিক্ষার্থী মো. শুভ (২২), বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. সাইদ (২৪), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের আসাদ বিন ইসকার (২২), স্কুলছাত্র রাকিব শাহরিয়ার, আন্দোলনকারী মো. ইসমাইল (৩১), পথচারী মো. ইলিয়াস (২০) ও বোরহান উদ্দিন (২৫)।
এদিকে বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানায় হামলা হয়েছে। এ সময় থানার মূল গেইট ভাঙচুর করে থানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোঁড়া হয়। এর আগে বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সে আগুন দেয় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এতে বক্সের ভেতরে থাকা অন্তত ছয়টি মোটরসাইকেল পুড়ে যায়। ওই সময় তিন যুবককে অস্ত্র হাতে গুলি চালাতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। সংঘর্ষে দুই কনস্টেবলও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে নতুন ব্রিজ এলাকায় অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীরা সড়ক অবরোধের চেষ্টা করে। দুপুর ১২টা থেকে বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এবং ট্রাফিক পুলিশবক্স সংলগ্ন রাস্তায় জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর পৌনে ২টার দিকে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বহদ্দারহাট মেয়র গলি ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে দুটি দলে ভাগ হয়ে বহদ্দারহাট মোড়ের দিকে আসতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র দেখেছেন। তারা শুরুতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এর জবাবে শিক্ষার্থীরাও ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকলে মুখোমুখি সংঘর্ষ শুরু হয়। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এভাবে সংঘর্ষ চলতে থাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একপর্যায়ে হঠাৎ করে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সরে যেতে থাকে মেয়র গলি ও চান্দগাঁও আবাসিকের দিকে। ঠিক ওই সময়ই একদল পুলিশ এসে সেখানে অবস্থান নেয়। এর একপর্যায়ে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারগ্যাস ছুঁড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এই সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এদিকে চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া কলেজ এলাকায়ও পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দুপুর সাড়ে ১২টার থেকে বাকলিয়া সরকারি কলেজের সামনে আসতে থাকেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ওই সময় সেখানে আগে থেকে অবস্থান নেওয়া পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। পুলিশও এরপর সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারগ্যাস ছাড়াও রাবার বুলেট ছুঁড়তে থাকে। এ সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের কয়েকটি দল এসে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয়। ওই সময় তাদের হাতে রামদা-কিরিচ ও লাঠিসহ দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র দেখা গেছে। বাকলিয়া কলেজ ও রাহাত্তারপুল এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার পরে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশ একযোগে ধাওয়া দেয় শিক্ষার্থীদের। এরপরই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে সরে যায়।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণার কারণে একদিকে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং অন্যদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক দীর্ঘ সময় ধরে অচল ছিল। ছোট যানবাহন কিছুটা দেখা গেলেও দূরপাল্লার গাড়িগুলো না চলায় পুরো মহাসড়ক ফাঁকাই ছিল। তবে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটসহ কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাকি অংশে গাড়িচলাচল মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল।
একদিনেই সারাদেশে ১৭ জন নিহত
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে সংঘর্ষে পুলিশ ও র্যাব এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে সারা দেশে এ পর্যন্ত মোট ১৭ জন মারা গেছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩ জন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ–যুবলীগ নেতা–কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে উত্তরায় ছয়জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে হাসপাতাল সূত্রে। এ ছাড়া ধানমণ্ডিতে সংঘর্ষে ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থী, আজিমপুরে মোহাম্মদ নামের একজন, রামপুরায় এক পথচারী, যাত্রাবাড়ীতে এক রিকশাচালক ও নাজমুল নামে এক ব্যবসায়ী, সাভারে এক শিক্ষার্থী এবং মাদারীপুরে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে নরসিংদীতে তাহমিদ তামিম (১৫) ও মো. ইমন মিয়া (২২) নামে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) থেকে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কর্মসূচি অনুযায়ী, হাসপাতাল ও জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে এবং রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া কোনো যানবাহন চলবে না বলে জানানো হয়।