চট্টগ্রামে আচমকা জ্বরে কাবু শিশুরা, মৌসুমী আপদ প্রভাব ফেলছে স্কুলেও

চট্টগ্রাম নগরীর পোস্তারপাড় সিটি কর্পোরেশন স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে আরিফা। কিন্তু দুই দিন স্কুলে যাওয়ার পরই তার হঠাৎ জ্বর এসে যায়। সেই জ্বরের মাত্রা এতো বেশি ছিল যে, উঠে দাঁড়ানোর শক্তিও ছিল না আরিফার। তবে চারদিন পর সেই জ্বর কমে যায়। পাঁচদিনের মাথায় জ্বর ছাড়ে পুরোপুরি। কিন্তু এরপর থেকে আরিফার মনে তো বটেই, তার অভিভাবকরাও খানিকটা শঙ্কিত হয়ে পড়েন— স্কুলে ফের পাঠাবেন কিনা তাকে।

চট্টগ্রামে আরিফার মতো এমন আরও অনেক শিশুই দুই-তিনদিন স্কুলে গিয়ে কিংবা ঘরে থেকেও জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। জ্বরের সঙ্গে পেট ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা নিয়ে অসুস্থ হওয়া শিশুর সংখ্যাও বেড়েছে হঠাৎ। অসুস্থ হচ্ছে বড় ক্লাশের অনেক শিক্ষার্থীও। হঠাৎ জ্বরের এমন দুর্ভোগে পড়ে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে চট্টগ্রাম শিশু হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটছেন অভিভাবকরা। যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারে। এর মধ্যে আবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত অনেক শিশুরোগীকেও হাসপাতালে নিতে হচ্ছে।

এর মধ্যেই আবার ভিন্ন একটি ধরন দেখা যাচ্ছে অনেক শিশুর মধ্যে। জ্বর একবার কমে যাওয়ার পরেও আবার জ্বর ফিরে আসছে। তবে করোনা বা ডেঙ্গুর উপসর্গ না থাকলে এমন ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

হঠাৎ এমন মৌসুমী অসুখের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম নগরীর স্কুলগুলোতেও। বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর স্কুলগুলোর ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের যে উপস্থিতি ছিল, ধীরে ধীরে তা কমতে শুরু করেছে। শিক্ষকরা বলছেন, কিছু কিছু স্থানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা করোনায় সংক্রমিত হওয়ার খবরে অভিভাবকদের মধ্যে খানিকটা ভীতি কাজ করছে।

নগরীর আগ্রাবাদের হাজিপাড়ার বাসিন্দা সাহানা ইসলামের দুই মেয়ে। ছোট মেয়ের বয়স সাড়ে তিন বছর। দুইদিন পার হয়ে গেলে জ্বর তিন থেকে সাড়ে তিন ডিগ্রি থাকছে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এখন সময়টাই অন্যরকম। খেলাধুলা করে খাওয়া-দাওয়া করে সুস্থ বাচ্চা রাতে ঘুমিয়ে গেল, সকাল থেকে দেখি গা গরম। দুপুরের আগে থেকে জ্বর উঠে গেলো ১০৪। কী যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে বলে বোঝানো যাবে না।’

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন সেখানে ৬০ থেকে ৭০ জন শিশু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তাদের মধ্যে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুর সংখ্যাই বেশি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বহির্বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চমেক হাসপাতালের শিশু বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১৮০ থেকে ১৯০ জন শিশু রোগী আসছে। যার মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জ্বরের রোগী থাকছে। আমরা এ জ্বরকে ভাইরাল ফিভারই মনে করছি। জ্বরের সাথে সর্দি থাকছে। প্রথম দুই দিন জ্বরের তাপমাত্রা থাকছে বেশি।’

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় জ্বর ১০৪ থেকে ১০৫-ও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তবে দুদিন পর থেকে সচরাচর সেই তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। জ্বরটা তিন থেকে চারদিন স্থায়ী হচ্ছে। আমরা জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের প্যারাসিটামল ওষুধটাই ৬ ঘন্টা পর পর খাওয়াতে পরামর্শ দিচ্ছি।’

ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘চমেক হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত অনেক শিশুরোগীও আসছে। তবে নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই চিকিৎসক অবশ্য বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার কারণে জ্বরে পড়ছে— এমন ধারণা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘এখন গরমের শেষ। শীতের শুরু। এই ঋতু বদলের সময় ভাইরাল ফিভার ঘরে ঘরে দেখা দেয়। একটা পরিবারের সবাই একের পর এক জ্বরে পড়ছে। তাই ঘরে যখন শিশুসন্তান থাকে, তারাও এই জ্বরে কাবু হয়। জ্বরের পর কয়েকদিন শিশুদের রোদ কিংবা ধুলোবালিতে বের না করাই ভালো।’

স্কুলের জন্য ৪ দফা জরুরি নির্দেশনা
এদিকে সব পরিস্থিতি বিবেচনা করোনা আক্রান্ত ও করোনার লক্ষণ পাওয়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য আরও চার দফা জরুরি নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।

গত মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের এক সংক্রান্ত আদেশে জানানো হয়েছে, শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের পর প্রথমেই শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে খোঁজখবর নেবেন। শিক্ষার্থীর পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত বা করোনার লক্ষণ (জ্বর, সর্দি, কাশি ইত্যাদি) আছে কিনা তার খোঁজ নেবেন। কোনও শিক্ষার্থী বা তার পরিবারের কারও করোনা বা করোনার লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত সেই শিক্ষার্থীকে আইসোলেশনে রেখে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠান প্রধান ওই শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক এবং সব শিক্ষার্থীর দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনা টেস্ট করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

চট্টগ্রাম সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসমত জাহান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা প্রতিটি শিক্ষার্থীর বাড়িতে বতমানে কারও করোনা হয়েছে কিনা সেটি জানার চেষ্টা করছি। পরিবারের কারও করোনা হলে তাকে স্কুলে আসতে নিরুৎসাহিত করছি। অনেক ক্ষেত্রে তাকে আইসোলেটেড থাকতে পরামর্শ দিচ্ছি। কারণ একজন থেকেই অন্যজনের শরীরে প্রবেশ করছে করোনার জীবাণু।’

তিনি বলেন, ‘আজ (৩০ সেপ্টেম্বর) প্রতিটি ক্লাশে সব শিক্ষার্থীকে এই বিষয়টি জানানো হয়েছে যে, ‘পরিবারের কারও করোনা হলে সাথে সাথে স্কুল প্রধান কিংবা ক্লাশ শিক্ষককে জানাতে। আর কেউ অসুস্থ অবস্থায় স্কুলে আসলে আমরা সাথে সাথেই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি কিছু নির্দেশনা দিয়ে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!