চট্টগ্রামে আইসিইউতে ২ ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস অপারেশনে জীবন পেলেন মুমূর্ষু রোগী
নাড়িভুঁড়ির অর্ধেকই ছিল পঁচা
১১ দিন ধরে জ্বর আর পাঁচ দিন ধরে শ্বাসকষ্ট। এমন এক শারীরিক অবস্থা নিয়ে গত ২৫ জুলাই চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তি হন এক রোগী। শ্বাসকষ্টের চেয়েও ওই রোগীর পেট ব্যথা ছিল প্রচণ্ড। ডাক্তাররা বুঝতেই পারছিলেন না কী তার কারণ? সম্ভাব্য সব পরীক্ষাই করানো হয় তাকে— এমনকি সিটি স্ক্যানও করা হয় পেটের। কিন্তু পেট ব্যথার কোনো উন্নতি হয় না।
সোমবার (২ আগস্ট) আলমগীর নামে ৫৩ বছর বয়সী সেই রোগীর নমুনায় করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়। এ সময় ধীরে ধীরে কমতে থাকে ওই রোগীর অক্সিজেন লেভেল। অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে যেতে থাকলে সেই রোগীকে ওই দিনই সন্ধ্যায় আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তার পেট ব্যথার কোনো কূলকিনারা করা যাচ্ছিল না কোনোভাবেই। এদিকে সেই রোগীর ব্লাড প্রেসার মারাত্মক পর্যায়ের কম। অক্সিজেন স্যাচুরেশন নেমে গেছে ৭৪ থেকে ৭৮%। সিপ্যাপ সাপোর্টে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল মিনিটে ১০০ লিটার গতিতে।
মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) আরও কয়েকটি রিপোর্ট পাওয়া গেল। সেই রিপোর্টগুলো থেকে জানা গেল— কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে না, ক্রিয়েটিনাইন বেশি, প্রোক্যালসিটোনিনের মাত্রা ২১.৪। এর মানে সিভিয়ার সেপসিস হয়েছে রোগীর। প্রো বিএনপি সাড়ে পাঁচ হাজার, যার অর্থ রোগীর হার্ট ফেইলিউর হয়েছে। সবমিলিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘টেবিল ডেথ’। ডাক্তাররা বুঝতে পারছিলেন, সমস্যাটা রোগীর পেটেই। কিন্তু কোনো নিশ্চিত এভিডেন্স নাই।
ওই রোগী চট্টগ্রামের সার্জন ও ইউরোলজিস্ট ডা. আলমগীর ভূইয়ার ভগ্নিপতি। মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে ডা. আলমগীর পার্কভিউ হাসপাতালে ওই রোগীকে দেখাশোনা করা চিকিৎসককে বললেন, ‘রোগী তো মরেই যাবে, আমরা কি একটু অপারেশন করে দেখবো?’
কিন্তু সেখানেও ছিল সমস্যা। একে তো রোগীটি নরএ্যাড্রেনালিন হাইয়েস্ট ডোজের রোগী। কোনরকমে ৮০-৯০ সিস্টলিক প্রেসার মেইনটেইন করছে। তার ওপর ১০০ লিটার অক্সিজেনে স্যাচুরেশন মাত্র ৭৪। এরকম সিভিয়ার প্যাশেন্টের ‘টেবিল ডেথ’ অনেকটা নিশ্চিত বলা চলে। আবার যদিও অপারেশন নাও হয়, তাহলেও মৃত্যু নিশ্চিত। তবে ডা. আলমগীর নিজের শ্যালকের জন্য এটাকেই নিলেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে।
সেই পরিস্থিতির বিবরণ দিতে গিয়ে পার্কভিউ হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়ান ডা. জিতু দাশ গুপ্ত বলেন, ‘ওই মুহূর্তে আমার কাজ ছিল অপারেশনের জন্য অ্যানেসথেসিয়া কিভাবে দেবো এটা ঠিক করা। হঠাৎ মনে পড়লো লিজেন্ড ডা. সৈয়দ আরিফ স্যারের কথা, এসএসএমসির। ওনার নাম্বারে ফোন করে পরিচয় দিলাম। কিভাবে জানি না, আমাকে উনি মনে রেখেছেন। উনার সাথে আলাপ করেই কাজে নেমে পড়লাম। ঠিক হলো অপারেশন আইসিইউতেই হবে। পাক্কা ২ ঘন্টার যুদ্ধ। পেট কাটা মাত্রই দেখা গেল অর্ধেক ইনটেসটাইন (নাড়িভুঁড়ি) পঁচে গেছে। আমাদের ডায়াগনসিস ছিল—Ischemic Necrosis of the gut due to hypercoagulopathy and micro embolus to superior mesenteric artery….
ডা. জিতু দাশ গুপ্ত বলেন, ‘অসাধারণ দক্ষতায় ডা. আলমগীর ভাই পঁচা অংশ আলাদা করে ফেলে দিলেন। এবং শেষপর্যন্ত সাকসেসফুল একটি অপারেশন।’
সবধরনের আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন অপারেশন থিয়েটারে যে অপারেশন করা কিংবা অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার সাহস করবেন না অনেকে, সেই অপারেশন হল আইসিইউর বেডেই। তাও ভেন্টিলেটর কিংবা ইনটিউবেশন ছাড়াই।
ঝুঁকি নিয়ে অপারেশনে নামা সেই ইউরোলিস্ট ও সার্জন ডা. আলমগীর ভূইয়া বলেন, ‘কঠিন এক মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে সফল অপারেশন করেছি। রোগী ‘টেবিল ডেথ’ হওয়ার পরেও একবার চেষ্টা করে সফল হলাম। এক্ষেত্রে রোগী আমার আপন বোনের জামাই হওয়ায় অনেকটা ঝুঁকি নিতে সাহস করি। বর্তমানে রোগীর অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে বাকিটা সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভর করছে।’
ডা. জিতু দাশ গুপ্ত এই সঙ্গে এও বলেন, ‘রোগী শেষ পর্যন্ত সারভাইভ করবে কিনা জানি না। কিন্তু সাকসেসফুল প্রসিডিউরের সুবাদে তখন থেকে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াচ্ছি। এখন আর আফসোস থাকবে না। অপারেশনের মাত্র ১ ঘন্টা পরই রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন এখন ৯৯%, যদিও গতি এখনও ১০০ লিটারেই আছে।’
‘রোগীটাকে সবাই প্রার্থনা রাখবেন’— বললেন ওই চিকিৎসক।
সিপি