চট্টগ্রামে অনলাইনে বিক্রি হল ৭১ হাজার গরু, ঐতিহ্যের হাট মার খাচ্ছে অনলাইনের হাতে

চট্টগ্রামেই ৫৩০ কোটি টাকার পশু বিক্রি অনলাইনে

চট্টগ্রামের হাটগুলো যখন শত শত গরু নিয়ে ক্রেতার জন্য অধীর অপেক্ষায়, সেই সময়ে অনলাইনে কেবল চট্টগ্রামেই বিক্রি হয়ে গেছে পৌনে এক লাখ গরু। ব্যক্তিমালিকানাধীন খামার থেকে সরাসরি বিক্রি হয়েছে আরও অন্তত ৩৫ হাজার গরু। সবমিলিয়ে হাট থেকে গরু কেনার যে ঐতিহ্য চট্টগ্রামবাসীর, এই করোনাকালে সেই প্রথাগত অভ্যাস অনেকটাই বদলে গেছে। ক্রেতারা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অনলাইনের দিকে ঝুঁকেছে হাজারগুণ বেশি। বুধবার (১৪ জুলাই) পর্যন্ত চট্টগ্রামে অনলাইনে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫৩০ কোটি টাকার গরু।

বিশাল করে টাঙানো হয়েছে সামিয়ানা। তার নিচে সারি সারি খুঁটি। তাতে বাঁধা নানা রঙের নানা ঢঙের শত শত গরু। এসব গরুর মধ্যে কোনোটির নজর কাড়ছে ‘ইয়া বড়’ শিঙ। আবার কোনোটির নজর কাড়ছে হৃষ্টপুষ্ট বিশালদেহী কিংবা রঙের গরু। শুক্রবার (১৬ জুলাই) সকালে চট্টগ্রাম নগরীর সাগরিকা গরুবাজারের চিত্র দেখা গেল এমনই। সাজানো পরিপাটি, গোছানো হাট— এভাবেই প্রস্তুত হাজার হাজার কোরবানি পশুর লক্ষাধিক ক্রেতার বেচাকেনার আয়োজন উপলক্ষে।

কিন্তু আভিজাত্যপূর্ণ এই আয়োজন এবার কতটা সফল হবে তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

শুধু এই হাটই নয়, সংশ্লিষ্টরা বলছেন— চট্টগ্রামের বিবিরহাট, মইজ্জারটেক বাজার, সল্টগোলা ক্রসিং, নুর নগর হাউজিং হাটসহ বিভিন্ন হাটে গরু বেচাকেনায় প্রভাব ফেলতে পারে বিকল্প গরুর স্থানগুলো। কারণ এবার অনলাইনে সাড়া পেয়েছে গরু বেচাকেনা। শুধুমাত্র প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের অনলাইন হাট থেকেই চট্টগ্রামে অনলাইনে বিক্রি হয়েছে ৭১ হাজার গরু। অন্যদিকে খামার থেকে বিক্রি হয়েছে সরাসরি ৩৫ হাজার গরু।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সারা দেশেই অনলাইনে পশু বিক্রিতে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগে মোট এক লাখ ২৬ হাজার ৪৬৫টি পশু বিক্রি হয়েছে, যার বাজারদর ৮৯৪ কোটি ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৯৪৮ টাকা। পরের স্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগে এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার ৮৫১টি পশু বিক্রি হয়েছে ২৬১ কোটি ৪২ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৭ টাকায়।

অনলাইনভিত্তিক প্লাটফর্মের পাশাপাশি গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠানেও মিলছে গরু। খামারের পাশাপাশি গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করার উদ্যোক্তাদের অ্যাগ্রো ফার্মগুলোতেও গরু মিলছে অপেক্ষাকৃত কম দামে। ক্রেতারা বলছেন, হাটের তুলনায় সুন্দর গরুও পাওয়া যাচ্ছে এসব স্থানে। একদিকে করোনার ভয়, অন্যদিকে হাসিলের বাড়তি খরচ এড়াতে ক্রেতারা হাটের পরিবর্তে গরু কিনতে নির্ভর করছে বিকল্প এসব উৎসের ওপর।

শুক্রবার (১৬ জুলাই) সকালে নগরীর কর্ণফুলী এলাকার মইজ্জারটেক হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় পাঁচ মণ ওজনের একটা গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অথচ ৭-৮ কিলোমিটার দূরে পটিয়া বাইপাস মোড়েই ব্যক্তিগত উঠানে এমন ওজনের গরু দাম চাওয়া হচ্ছিল মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

দামের তারতম্য শুধু বড় গরুর ক্ষেত্রে নয়, ছোট গরুর ক্ষেত্রেও ঘটছে একই ঘটনা। দুই-আড়াই মণ ওজনের যেসব গরুর দাম বড় হাটগুলোতে ৮০-৯০ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে, ঠিক সেই ওজনের গরু গ্রামের উঠান কিংবা বাজারগুলোতে মিলছে মাত্র ৫০-৬০ হাজার টাকায়।

পশুর বড় হাটগুলোতে এখনও কেন ক্রেতা কম— এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল— শুধু উচ্চমূল্য নয়, ক্রেতাদের সামনে আসছে করোনা ইস্যুও। করোনার ভয়ে মানুষ এখন বড় হাটগুলোর দিকে ঝুঁকছে কম। ভিড় এড়িয়ে চলতে চাইছে ক্রেতারা।

চট্টগ্রামে বড় হাটগুলোর অধিকাংশ গরু বিক্রেতাই রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, কুষ্টিয়া এলাকার। আর করোনার সংক্রমণ সেই এলাকাগুলোতেই বেশি। সবদিক বিবেচনা করে কম দামে ও ঝামেলাহীন গরু কিনতে মানুষ বেছে নিচ্ছে ছোট ছোট হাট, খামার কিংবা গ্রামকে।

বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আব্দুর রব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বললেন, ‘কোরবানির ঈদ আমাদের চাইতেও বাচ্চাদের জন্য বেশি আনন্দের। এই ঈদের মাসখানেক আগে থেকে বাচ্চারা গরুর জন্য কান্নাকাটি শুরু করে। অনেকটা বাধ্য হয়েই আগেভাগে যেতে হলো হাটে। কিন্তু যেভাবে করোনা বাড়ছে, ভিড়ের মধ্যে বড় হাটগুলোতে যেতেও ভয় হয়। তাই সুরক্ষা ও কম ঝুঁকির কথা চিন্তা করে খামার কিংবা গ্রামের ছোট হাটগুলোতেই যাব। এসব জায়গায় দাম কম পাওয়া যায়, ভিড়ও কম, হাসিলও দিতে হয় না।’

সাগরিকা গরু বাজারে কয়েকজন ক্রেতা জানান, এই হাটে ছোট হোক আর বড় হোক অস্বাভাবিক দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতারা। বিপরীতে সারা এগ্রো, নাহার এগ্রোর মত নামকরা প্রতিষ্ঠানে হাটের তুলনায় গরুর দাম ২০ শতাংশ কম। তারা হাটের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের তুলনা করতেই সাগরিকা গরুর হাটে এসেছেন।

ব্যক্তিমালিকানাধীন কয়েকটি খামারের মালিক জানান, নিজেদের ফার্মেই কোরবানির জন্য তারা গরু লালনপালন করেন। একসাথে অনেক গরু লালনপালনে তুলনামূলক খরচ কম হয়। তাছাড়া বাজারে যেসব গরু আনা হয়, সেগুলো অন্য জেলাগুলো থেকে আনতে গাড়িভাড়া, থাকা খরচ, টোল খরচ মিলিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়— যে বাড়তি খরচ খামারগুলোতে প্রয়োজন হয় না। তাই অনায়াসে লাভ করেও ক্রেতাদের কম দামে গরু দিতে পারে তারা। তাছাড়া অ্যাগ্রো ফার্মগুলোতে সুন্দর পরিবেশ ও কম জনসমাগম হয় বলে অনেক মানুষ এখন বড় হাট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

জানা গেছে, ক্রেতাদের ছোট বাজার বা খামারমুখী হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে ইজাদারদের নির্ধারিত হাসিল। বড় হাট থেকে এক লাখ টাকার একটি গরু কিনে ৫ হাজার টাকা হাসিল গুণতে হয় ক্রেতাকে। এই টাকাটা ক্রেতার বেচে যায়— যদি এগ্রো কিংবা খামার থেকে গরু কেনেন। সেই হাসিলের কথা চিন্তা করেও অনেকে ভিড়ছেন এই উঠান বাজারগুলোর দিকে।

সাগরিকা গরুর বাজার, মইজ্জারটেক বাজার, বিবিরহাট, রুপনগর বাজারের মত বড় হাটগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখনও সেখানে সেভাবে বেচাকেনা শুরু হয়নি। দূরদুরান্ত থেকে এসে এখনও সেই লম্বা যাত্রার ক্লান্তি দূর করতে পারেননি গরু বিক্রেতারা।

একাধিক গরু বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, ক্রেতারা এখন এসে গরু দেখে দাম জিজ্ঞেস করে চলে যাচ্ছে। সারাদিনে দু-একটা গরু বিক্রি করতে পারছেন বিক্রেতারা। তবে গরু ব্যাপারিদের আশা, দু-একদিনের মধ্যে বড় হাটগুলোতে বেচাকেনা বেড়ে যাবে।

তবে এবার বড় হাটগুলোর বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ‘অনলাইন গরুর বাজার’। যেখান থেকে গরু কিনছেন মন্ত্রী-এমপিসহ স্বাস্থ্য সচেতন ক্রেতারাও।

প্রথমবারের মতো অনলাইনে গরু বিক্রির কার্যক্রম শুরু করে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। চট্টগ্রাম জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদফতরের ‘অনলাইন হাটে’ এবার মোট ৩৭টি খামারের গরু বিক্রি হচ্ছে।

অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বুধবার (১৪ জুলাই) পর্যন্ত চট্টগ্রামে অনলাইনে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫৩০ কোটি টাকার গরু।

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে গরু বিক্রিতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের ৩৭টি অনলাইন প্লাটফর্মে এ পর্যন্ত আপলোড হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার কোরবানি পশু এবং অনলাইনে বিক্রি হয়েছে ৭১ হাজার গরু। তাছাড়া খামার থেকে সরাসরি বিক্রি হয়েছে ৩৫ হাজার কোরবানি পশু।

সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে বিক্রি হয়েছে ১১০০ কোটি টাকার গরু। যার মধ্যে ৫৩০ কোটি টাকার গরু বিক্রি হয়েছে অনলাইনে।

এসব বিবেচনায় এখন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গরুর হাটগুলো তাদের ঐতিহ্য কতটা রক্ষা করতে পারবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে ঈদুল আজহার আগের দিন পর্যন্ত।

এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!