চট্টগ্রামের ৬ হাসপাতালের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক জিম্মি, রাস্তায় পার্কিংয়ে নিত্য যানজট
পার্কিংয়ের ব্যবস্থাই নেই প্রায় সব হাসপাতালে
পার্কিং ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে চট্টগ্রামের প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেবা নিতে আসা ‘বড়লোক’দের গাড়ি পার্কিং হয় মূলত সামনের রাস্তা ও ফুটপাতে। এ কারণে সংকুচিত হয়ে যায় মূল সড়ক। তাতে সাধারণ মানুষের পথ চলতে বেগ পেতে হচ্ছে। অন্যদিকে যানজট লেগেই থাকছে দিনের পর দিন।
দেখা গেছে, মাত্র ছয়টি বেসরকারি হাসপাতালের কারণে চট্টগ্রাম নগরীর বিশাল এক ব্যস্ততম এলাকায় প্রায় সময়ই দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকে। এই হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে— চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, সিএসসিআর হাসপাতাল, ম্যাক্স হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার ও এপিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। মূল সড়কের ধারে গড়ে ওঠা এসব বেসরকারি হাসপাতালের কারণে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের আশপাশ এলাকা, প্রবর্তক মোড়, গোলপাহাড় মোড় থেকে জিইসি মোড়, মেহেদীবাগ থেকে চট্টেশ্বরী মোড় পর্যন্ত এলাকায় মানুষকে চরম ভোগান্তি হচ্ছে।
মাথায় গুরুতর জখম হওয়া সাতকানিয়ার রুহুল আমিনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হচ্ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যানজটের কারণে চকবাজার হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল পর্যন্ত স্বল্প দূরত্ব পার হতেই তাদের সময় লেগেছে ৩০ মিনিটেরও বেশি। অথচ গাড়িতে করে এক মিনিটে যাওয়া যায় চকবাজার থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে। রুহুল আমিনের সন্তান তাইফুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বাবা অ্যাক্সিডেন্ট করে মাথায় মারাত্মক আঘাত পান। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা চট্টগ্রাম মেডিকেলে রেফার করে। ডাক্তার বলেছেন আর একটু দেরিতে অপারেশন হলে বাবাকে বাঁচানো যেত না।’
তবে শুধু তাইফুর নন, চট্টগ্রাম মেডিকেল ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী নিয়ে আসা স্বজনদের অনেকেই বলেছেন অসহনীয় যানজট ও ভোগান্তির কথা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ফটকের বিপরীতে এপিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পার্কিং সংকট যেমন আছে, তেমনি আছে অব্যবস্থাপনা। ফলে এপিকের সামনে সারাক্ষণ লেগেই থাকে যানজট। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গাড়ি পার্ক করার জায়গায় বসানো হয়েছে ফিজিওথেরাপি সেন্টার। পার্কিংয়ের বাকি অংশে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২টি গাড়ি পার্কিং করার জায়গা আছে। এপিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ১০০ থেকে ১২০ জন ডাক্তার রোগী দেখেন। প্রায় সব ডাক্তারেরই আছে নিজস্ব গাড়ি। প্রশ্ন থেকে যায়, বাকি ডাক্তারদের এতগুলো গাড়ি কোথায় রাখা হয়? সেবা নিতে আসা রোগীদের ব্যক্তিগত গাড়ি রাখবে কোথায়— সেটা পরের প্রশ্ন। এই উত্তর মিলেছে একটিই— এসব গাড়ি রাখা হয় রাস্তা দখল করে ও ফুটপাতের ওপরে। দখলে ছোট হয়ে যায় সড়ক আর যানজটে ভোগান্তি বাড়ে মানুষের।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশেপাশের এলাকায় ৪০টির বেশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পার্কিং ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, সিএসসিআর হাসপাতাল, ম্যাক্স হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার ও এপিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছোট আকারের পার্কিং স্পেস থাকলেও সেবা নিতে আসা লোকজন সেখানে পার্কিং করতে পারে না। এ কারণে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের আশপাশ এলাকা, প্রবর্তক মোড়, গোলপাহাড় মোড় থেকে জিইসি মোড়, মেহেদীবাগ থেকে চট্টেশ্বরী মোড় পর্যন্ত প্রায় সময়ই দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকে। এসব সড়কে শৃঙ্খলা ও যানজট নিরসনে কাজ করে ট্রাফিক পুলিশ। তবে তারাও বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের সামনে অসহায়।
প্রবর্তক এলাকার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মনজুর হোছাইন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অযৌক্তিকভাকে কেউ গাড়ি পার্কিং করলে আমরা নো-পার্কিং মামলা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছি। সিএসসিআর, মিমি সুপার মার্কেট ও এপিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা নেই। যার কারণে মেডিকেলের আশপাশের এলাকায় যানজট লেগে থাকে।’
নগরীর ওআর নিজাম রোডের সিএসসিআর হাসপাতালে নিয়মিত রোগী দেখেন ৬২ জন চিকিৎসক। এই চিকিৎসকদের প্রায় সবারই ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। এছাড়া সিএসসিআর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে তিন থেকে চারটি। কিন্তু পার্কিংয়ের জায়গায় মাত্র দুই থেকে তিনটি গাড়ি পার্ক করা যায়। হাসপাতালটি ঘুরে দেখা গেছে, পার্কিংয়ের জায়গায় হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রাখা হয়েছে। যথাযথ পার্কিং ব্যবস্থা না রাখায় এই হাসপাতালের কারণে যানজট লেগেই থাকে সামনের গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিতে।
সিএসসিআর হাসপাতালের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ডা. সালাউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের হাসপাতাল হয়েছে ১৫ বছর আগে। ১৫ বছর আগে বিল্ডিং নির্মাণের সময় চাহিদার চেয়ে বেশি পার্কিং রাখা হয়েছিল। এখন গাড়ি বেড়েছে। সেজন্য এমন হচ্ছে। তবে আমরা রোগীদের জন্য অল্টারনেটিভ রেখেছি। হাসপাতালের অল্প দূরে আরেকটি ভবনে আমাদের পার্কিং রয়েছে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল নগরীর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে অন্যতম। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পার্কিংয়ের প্রবেশমুখ বন্ধ। গাড়ি পার্কিং করার জায়গায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লোহা-সিমেন্ট রেখে ভবন নির্মাণের কাজ করছে। মেট্রোপলিটন হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের গাড়ি ছাড়াও হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স ও মাইক্রোবাস রয়েছে। হাসপাতালটির নিরাপত্তারক্ষী জানান, মেট্রোপলিটন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাশে আরও একটি ভবন নির্মাণ করছে। ওই ভবনের নির্মাণ সামগ্রীগুলো পার্কিং করার জায়গায় রাখা হয়েছে। যার কারণে এখন শুধু দুই থেকে তিনটি গাড়ি পার্কিং করা যায়। মেট্রোপলিটন হাসপাতালের একটু দূরে গোলপাহাড় মোড়ে রয়েছে মেট্রোপলিটন ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেখানেও গাড়ি পার্কিং করার কোনো ব্যবস্থা নেই।
মেট্রোপলিটন হাসপাতালে বিপরীতে রয়েছে মেডিকেল সেন্টার হাসপাতাল। সেখানেও একই দশা। ডাক্তারদের গাড়ি ছাড়া অন্য কারও গাড়ি পার্কিং করা যায় না। এছাড়া পাশের রয়েল হাসপাতালেও পার্কিং নেই। এই হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ পার্কিংয়ের জায়গায় বানিয়েছে কর্মচারীদের থাকার রুম।
সিএসসিআর হাসপাতাল থেকে কিছু দূরে বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতাল। ম্যাক্স হাসপাতালের সামনে সাঁটানো বিলবোর্ডে দেখা যায় কমপক্ষে শতাধিক ডাক্তারের নাম। যথারীতি এখানেও রয়েছে পার্কিং সংকট। হাসপাতালের নিচে পার্কিংয়ের জায়গায় বানানো হয়েছে এবাদতখানা। এছাড়া হাসপাতালের যন্ত্রাংশ এনে ভরানো হয়েছে পার্কিংয়ের বড় একটি অংশ। বাকি জায়গায় সর্বসাকুল্যে ১৩ থেকে ১৫টি গাড়ি পার্কিং করা যায় কোনোমতে।
ম্যাক্স হাসপাতালের বিপরীতে কয়েক গজ দূরে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতাল ও সিগমা ল্যাব। সেখানেও একই দশা। পর্যাপ্ত পার্কিং নেই। ম্যাক্স হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পার্কিং অব্যবস্থাপনার কারণে মেহেদীবাগ জুড়ে অসহনীয় যানজট সেখানকার মানুষ নিয়তি হিসেবেই ধরে নিয়েছে।
সিপি