চট্টগ্রামের ২৮ হাজার পরিবহন শ্রমিক দুর্দশায়, পাশে নেই নেতারাও

বাসা ভাড়া দিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের পেটে যোগান দিতে হবে খাবার। অসুস্থ বাবা-মা কিংবা স্ত্রী-সন্তানের চিকিৎসা ব্যয়ও মেটাতে হবে তাকে। কিন্তু কিভাবে? গাড়ির চাকা ঘুরছে না। এই চাকা না ঘুরলে যে ঘোরে না তাদের ভাগ্যের চাকাও! দিনে এনে দিনে খাওয়া পরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশা এখন চরমে পৌঁছেছে।

করোনার ঝুঁকি মোকাবেলায় ২৬ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সকল যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। এই বন্ধের অর্ধেক সময় পেরোতেই চট্টগ্রাম মহানগরের ২৮ হাজার গণপরিবহন চালক-হেলপারের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। দিনে এনে দিনে খাওয়া এই শ্রমিকদের এখন আয় নেই কানাকড়িও।

শ্রমিকদের নানা কল্যাণের কথা বলে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা নেয় শ্রমিক সংগঠনগুলো। শ্রমিকের ঝরানো ঘামে ‘উৎপাদিত’ অর্থে কোটি কোটি কামাই করে পরিবহন মালিকরা। কিন্তু এই সংকটে তাদের পাশে নেই কোন মালিক কিংবা শ্রমিক সংগঠন।

করোনাভাইরাস দেশে শনাক্ত হওয়ার পরপরই চট্টগ্রাম শহর ফাঁকা হতে শুরু করে। পরিবহন শ্রমিকরা জানায়, ২০ মার্চ থেকেই যাত্রী কমে যায় সড়কে। এ কারণে জ্বালানি খরচ আর গাড়ির মালিকের ‘ইনকাম’ তুলতে পারেনি পরিবহন শ্রমিকরা। ২৬ মার্চ থেকে সড়কে গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করায় পরিবহন শ্রমিকদের আয়ের পথ পুরোপুরি থেমে যায়। আয় বন্ধ হওয়ার কারণে বাসা ভাড়া ও পরিবারের খরচ মিলে আর্থিক সংকটে পড়ে চরম দুর্দিন পার করছে তারা।

জানা গেছে, চট্টগ্রামে মালিকদের প্রায় সাতটি ও শ্রমিকদের তিনটির বাইরে আরো কয়েকটি সংগঠন রয়েছে। মালিকদের সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রো পরিবহন মালিক সমিতি, চট্টগ্রাম সিটিবাস মিনিবাস হিউম্যান হলার মালিক সমিতি, যাত্রী সেবা পরিবহন সার্ভিস মালিক সমিতি, লুসাই পরিবহন মালিক সমিতি, কালুরঘাট বাস মিনিবাস মালিক সমিতি, চট্টলা পরিবহন মালিক সমিতি।

শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর বাস, মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম মহানগরী হিউম্যান হলার চালক সহকারী শ্রমিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম মহানগরী হিউম্যান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরে বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার, টেম্পো মিলে প্রায় ১৫ হাজার গণপরিবহন চালক ও হেলপার রয়েছে। এছাড়া ১৩ হাজার সিএনজি অটোরিকশা চালক রয়েছে। সে হিসেবে গণপরিবহন ও সিএনজি অটোরিকশা মিলে প্রায় ২৮ হাজার শ্রমিক রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরে।

নগরীর রৌফাবাদ কলোনি এলাকার বাসচালক মাহতাব, আশরাফুল, করিম, মিজানসহ অনেকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা অভিযোগের সুরে বলেন, আমরা দিনে এনে দিনে খাই। একদিন গাড়ি চালাতে না পারলে পরিবারকেও না খেয়ে থাকতে হয়। করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি থাকায় গাড়ি বন্ধ। এ কারণে আমরাও বেকার ১০ দিন ধরে। খুব কষ্টে দিন পার করছি। দেখার কেউ নেই। সারা বছর যারা আমাদের অভিভাবক হিসেবে দাবি করেন যারা, শ্রমিকের নানা অধিকারের কথা বলেন যারা, এই দুর্দিনে তাদের দেখা নেই। যদি মালিক ও শ্রমিক নেতারা এই সংকটের সময়ে আমাদের পাশে না দাঁড়ান তাহলে সারা বছর এত শ্রমিক অধিকারের কথা বলে লাভ কী?’

তাদের অভিযোগ, একটি গাড়ি থেকে দৈনিক ‘ওয়েবিল’ নামে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিয়ে থাকে বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। আবার শ্রমিক কল্যাণ বাবদ ৩০ টাকা করে দিতে হয় তাদের। এছাড়াও বিভিন্ন অজুহাতেও শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো টাকা হাতিয়ে নেয় সংগঠনগুলো। অথচ এমন সংকটে শ্রমিকের পাশে নেই কোন সংগঠনের নেতাই।

চট্টগ্রাম মহানগর বাস, মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার প্রভাবে যানবাহন চলাচল বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকরা খুব কষ্টে দিন পার করছে। সব শ্রমিককে সহায়তা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পরিবহন মালিক সংগঠনের নেতাদের সাথে আমরা যোগাযোগ করলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। সামনের দিনগুলোতে শ্রমিকদের জন্য কী অপেক্ষা করছে তা ভেবে অস্থির। শ্রমিকদের সহযোগিতায় বিভিন্ন মালিক সমিতি ও সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।’

এদিকে পরিবহন মালিকদেরও যাচ্ছে এখন দুঃসময়। কয়েকজন পরিবহন মালিক জানান, টানা ১০ দিন গাড়ি বন্ধ থাকায় তাদেরও আয় বন্ধ হয়ে গেছে। আবার গাড়ি বন্ধ থাকলে ঠিকই দিতে হচ্ছে গ্যারেজ ভাড়া। অন্যদিকে টানা বন্ধ থাকার ফলে ইঞ্জিন-ব্যাটারিসহ গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তার আগে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার খবর আসার পর থেকেই যাত্রী কমে গেছে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকেই চালকরা ঠিকমত দিতে পারেনি গাড়ির ভাড়া (ইনকাম)। এতে লোকসানও গুণতে হয়েছে পরিবহন মালিকদের।

চট্টগ্রাম মেট্রো পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মো. বেলায়ত হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ঝুঁকি থাকায় গণপরিবহন বন্ধ। এতে চালক-হেলপার-মালিকের ইনকামও বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এখনও শ্রমিকদের কোন সহযোগিতা করিনি। তবে ছুটি বাড়ার কারণে আমরা শ্রমিকদের সহযোগিতা করার চিন্তা করছি।’

সিএম/এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!