চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে করোনার টিকা বেচে কথিত সুইপার, দিনে আয় ১ লাখ

২০ হাজার টাকায় ১ ভাওয়েল পুশ হয় ১০ জনের শরীরে

চট্টগ্রামে অনেক ক্ষেত্রেই ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন ধরেও পূর্বনির্ধারিত তারিখে মিলছে না করোনাভাইরাসের টিকা। অনেকে আবার টিকার প্রথম ডোজ পেলেও দ্বিতীয় ডোজ কবে দিতে পারবেন— সেটা নিয়েই আছেন দুশ্চিন্তায়। অথচ চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী গলিতে হাজারদুয়েক টাকা খরচ করলেই মিলছে করোনার সরকারি টিকার ‘দ্বিতীয় ডোজ’। এই টিকা নিযে বেশ কিছুদিন ধরেই সেখানে জেঁকে বসেছে জমজমাট ব্যবসা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘অস্থায়ী কর্মচারী’ হিসেবে এলাকায় পরিচয় দেওয়া এক লোক নগরীর হাজারী গলির একটি ঘরে নিজ হাতেই দিচ্ছেন করোনা টিকার ‘দ্বিতীয় ডোজ’। বলরাম চক্রবর্তী বলয় নামের সেই লোকটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘অস্থায়ী পরিচ্ছন্নতা কর্মী’ হিসেবে কাজ করেন বলে এলাকায় পরিচয় দিলেও চসিক সূত্রে জানা গেছে, বলয় আদৌ চসিকের পরিচ্ছন্নকর্মী নন। স্থানীয় কাউন্সিলর জহরলাল হাজারীও জানিয়েছেন, বলয় সিটি করপোরেশনের কেউ নন। তবে হাজারী লেন এলাকায় বলয়কে চসিক নিয়োজিত পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের নিয়মিত ‘তত্ত্বাবধান’ করতে দেখা যায় বলে এলাকাবাসী নিশ্চিত করেছেন।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাজারী গলির একটি ঘরে টাকার বিনিময়ে খুব সহজেই মিলছে করোনার টিকার দুষ্প্রাপ্য ‘দ্বিতীয় ডোজ’। বলরাম চক্রবর্তী বলয় এই টিকাদান নিয়ে নিজেই তৈরি করে রেখেছেন একটি ‘বলয়’। তবে টিকার লেনদেনে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেন তিনি। নির্দিষ্ট এজেন্টের মাধ্যমে তার কাছে না এলে টিকার কথা স্বীকার করেন না বলয়।

বিশেষ কৌশলে সরেজমিনে হাজারী গলিতে টিকা দেওয়ার ওই স্পটে গিয়ে দেখা গেছে, বলরাম চক্রবর্তী বলয় টিকার প্রতিটি ভাওয়েল (টিকার শিশির) ১০ জনের মধ্যে ভাগ করে দেন। অর্থাৎ প্রতিটি ভাওয়েল থেকে ১০ জনের শরীরে পুশ করা হয়। আর সেই টিকা নিজেই নার্সের দায়িত্ব নিয়ে পুশ করেন এই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এর বিনিময়ে প্রতিজন থেকে নেওয়া হয় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ছাড়ও রয়েছে। যেমন একসঙ্গে পাঁচজন টিকা নিলে রয়েছে ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা।

জানা গেছে, বলরাম চক্রবর্তী বলয় প্রতিদিন গড়ে ৫ ভাওয়েল টিকা ‘পুশ’ করেন ৫০ জন টিকাগ্রহীতার শরীরে। এ বাবদে তার প্রতিদিনের আয় প্রায় ১ লাখ টাকা। কখনওবা তারও বেশি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাজারী গলির একটি মন্দিরের পিছনে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষকে রীতিমতো করোনার টিকাদান কেন্দ্র বানিয়ে বসেছেন বলয়। সেখানে রয়েছে টিকা দেওয়ার জন্য ছোটখাটো চেম্বারও। গ্রহীতা জোগাড়ের জন্য তার রয়েছে একাধিক এজেন্ট। মূলত তাদের মাধ্যমেই সম্ভাব্য টিকাগ্রহীতাদের সংগ্রহ করা হয়।

Yakub Group

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে রয়েছে বলয়ের একাধিক ‘সোর্স’। তারা হাসপাতালে টিকা মারতে না পারা বিত্তবান ও প্রবাসীদের টার্গেট করে। ওই ‘সোর্স’রা কৌশলে টিকা ম্যানেজ করে দেবে— এমন লোভ দেখিয়ে টার্গেট করা লোকদের বলয়ের কাছে সোপর্দ করে। এর বাইরেও বলয়ের কাছ থেকে টিকা নেওয়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের অনেক কর্মকর্তাও একপর্যায়ে হয়ে উঠেছেন বলয়ের সোর্স। জানা গেছে, বলরাম চক্রবর্তী বলয়ের টিকাগ্রহীতাদের বেশিরভাগই সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা। তাদের মাধ্যমে তিনি পরবর্তীতে আরও গ্রাহক পেয়েছেন— এমন তথ্যও মিলেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গোপনীয়তা রক্ষার জন্য প্রথমে টিকা নিতে আগ্রহী লোকদের একই সময়ে হাজারীগলি শিবমন্দিরের মোড়ে জড়ো করেন বলয়। তারপর সবাইকে একত্রে মন্দিরের পিছনে দুই তলার অফিসে নিয়ে গিয়ে গোপনকক্ষে টিকা মারেন। অনেক সময় টিকার ভাওয়েলের অংশবিশেষ রয়ে গেলে সেটা ‘পুশ’ করা হয় পরেও।

জানা গেছে, টিকার টাকা নিয়ে সমঝোতা হলে সম্ভাব্য টিকাগ্রহীতাকে প্রথম ডোজ দেওয়ার কার্ডটি নিয়ে যেতে বলা হয়। পরে বলরাম টিকার ‘দ্বিতীয় ডোজ’ পুশ করে কার্ডে লিখে দেন।

এভাবে টাকার বিনিময়ে অবৈধ ও বিপজ্জনকভাবে টিকা দিয়ে গেলেও এই টিকার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। কারণ টিকার বিধিনিষেধে লেখা আছে, ভাওয়েলের ক্যাপ বা ছিপি খোলার দুই ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণ টিকা শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নইলে টিকার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, বলরাম চক্রবর্তী ভাওয়েলের ক্যাপ খুলে সারাদিনই ওই টিকা দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্নজনের শরীরে। ফলে ওই টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহে আছেন খোদ গ্রহীতাদের অনেকেই। তাদের কেউ কেউ এখন কী করবেন— সেটি নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।

সম্ভাব্য টিকাগ্রহীতা সেজে বিশেষ এক ‘এজেন্টের’ পরিচয় দিয়ে বলরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাকে চারজনের টিকা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়। বলরাম এ সময় ওই চারজনকে নিয়ে দ্রুত হাজারী গলির শিবমন্দিরের সামনে যেতে বলেন। তিনি এ সময় কিছুক্ষণের মধ্যে আরও কয়েকজনকে টিকা দেওয়া হবে বলে জানান।

প্রতিবেদক এ সময় ফোনে টিকার মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে বলরাম চক্রবর্তী বলেন, ‘আপনি যদি লেখাপড়া জেনে থাকেন, পড়ে দেখবেন একদম অরজিনাল। আমার কাছে দুই নম্বর টিকা নেই। আপনি তাড়াতাড়ি হাজারী গলি আসেন, এখানেই টিকাটা মেরে দেবো। আর এতোসব কথা মোবাইলে বলা ঠিক না। সামনাসামনি কথা বলব।’

পরে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এই প্রতিবেদক সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করলে বলরাম চক্রবর্তী বলয় বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। যদি রিপোর্টারের হাতে কোনো ডকুমেন্ট থাকে তবে নিউজ করে দেন। পরেরটা আমি দেখব।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারীর ‘খুব কাছের মানুষ’ হিসেবে পরিচিত এই বলরাম চক্রবর্তী। স্কুলের গন্ডি পার হতে না পারলেও বর্তমানে কাউন্সিলর হাজারীর ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবেও পরিচয় দেন বলয়। পরিবার নিয়ে থাকেনও কাউন্সিলরের দেওয়া ঘরে। মূলত সেই সুবাদে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘অস্থায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মী’ হিসেবে নিজের পরিচয় দেন তিনি— এমন অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।

তবে কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী বলরাম চক্রবর্তী বলয়ের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে। তিনি এও জানান, বলয় সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী নয়।

এই বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আক্তার বলেন, ‘সে কোত্থেকে এগুলো সংগ্রহ করছে আমি জানি না। আদৌ এটা টিকা নাকি তার মধ্যে পানি ঢুকিয়ে মারছে— সেটা সেই জানে। ঘটনা সত্য হলে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা উচিত।’

যেখানে করোনার সম্মুখযোদ্ধা ডাক্তাররাই নিজেদের জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে বলয়ের মত একজন অস্থায়ী সুইপারের হাতে এতো বিশাল পরিমাণ টিকা কোথা থেকে এলো— সে বিষয়ে কথা বলা হয় চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রথমে তাকে পুলিশের হাতে ধরাই দেন। তারপর সব তথ্য বের হয়ে আসবে। করোনার টিকা তো পাবলিকের হাতে যাওয়ার কোন সুযোগই নেই। তিনি টিকার বদলে পানি দিচ্ছেন কিনা তাও তো সন্দেহের কথা।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!