চট্টগ্রামের স্যানমার ৬ তলাকে ১২ তলা বানিয়ে ৬ আইনকেই বুড়ো আঙ্গুল
অবৈধ কাজকে হালাল করতে সিডিএর ভেতরেই বড় চক্র
চট্টগ্রামের উত্তর খুলশীতে ৬ তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ১২ তলা ভবন বানিয়ে এলাকায় বড় ঝুঁকির জন্ম দিয়েছে আবাসননির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যানমার প্রপার্টিজ। এতে সরাসরি লঙ্ঘন করা হয়েছে অন্তত ছয়টি আইন ও বিধিমালা। এরপরও এমন নজিরবিহীন অনিয়মে সরাসরি সহায়তা দিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) একটি চক্র। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনেও অভিযোগ গেছে সিডিএ কর্মকর্তা ও স্যানমার প্রপার্টিজের চেয়ারম্যানসহ নয় জনের বিরুদ্ধে।
চট্টগ্রামভিত্তিক স্যানমার প্রপার্টিজের বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে, নকশাবহির্ভূত, অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ বেশ পুরনো। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজস থাকায় কোনভাবেই দমানো যাচ্ছে না এ আবাসন প্রতিষ্ঠানটিকে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২২ জুন নগরীর উত্তর খুলশী ইম্পেরিয়াল হিলের ৪ নম্বর সড়কে ১০৯/সি নং প্লটে ‘স্যানমার গ্রানডি’ নামে একটি ভবন তৈরির জন্য সিডিএ থেকে ৬ তলার নকশা নেয় আবাসননির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যানমার প্রপার্টিজ লিমিটেড। ১০ থেকে ১২ ফুট প্রশস্ত রাস্তায় ছয় তলার ওপরে ভবনের অনুমোদন দেন না সিডিএ। কিন্তু এ ভবনের ছয় তলার অনুমোদন পেয়ে আবাসন প্রতিষ্ঠানটি নকশাবহির্ভূত ১২ তলা নির্মাণের কাজ শুরু করে। আইন অনুযায়ী দুই বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু তা বেআইনিভাবে সিডিএ কতৃপক্ষের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় আবার নকশা নিয়ে এখনও কাজ করে যাচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের পুনঃনকশা নেওয়াই অবৈধ।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মোট জমির ৬৫ শতাংশ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। ৩৫ শতাংশ খালি রাখতে হয়। কিন্তু স্যানমারের এ ভবন নির্মাণে ব্যবহার হয়েছে ৮৮ শতাংশ জায়গা।
এদিকে ছয় তলার পরিবর্তে ১২ তলা ভবন তৈরির বিষয়টি আশপাশের ভূমি মালিকদের দৃষ্টিগোচর হওয়াে পর স্যানমার প্রপার্টিজের নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের বিষয়ে তারা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে ১১ জন স্থায়ী বাসিন্দার স্বাক্ষরে করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বরাবর একটি অভিযোগ দেওয়া হয়। এতে স্যানমার প্রপার্টিজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও চেয়ারম্যান এম মাসুক হকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়।
ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ভবনটির উত্তর পাশে তিন মিটার দূরত্বের বদলে প্রতিষ্ঠানটি রেখেছে মাত্র পৌনে এক মিটার। একইভাবে দক্ষিণ পাশে তিন মিটারের পরিবর্তে এক মিটার, পূর্ব দিকে দেড় মিটারের পরিবর্তে এক মিটার এবং পশ্চিম পাশে তিন মিটারের পরিবর্তে দূরত্ব রাখা হয়েছে মাত্র দেড় মিটার। ওই সময় ভবনটির ১০ তলার নির্মাণকাজ শেষ হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, পাহাড়ের ঢালু জায়গার ওপরের অংশে বহুতল ভবন নির্মাণ করায় পাহাড় ধস, ভূমিকম্পসহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশপাশের অন্তত ১২টি প্লটের মালিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া বসবাসরত মানুষের প্রাণনাশসহ ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। অতিরিক্ত পরিমাণে পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের কারণে এ ঝুঁকি আরও বেশি বেড়েছে। রাস্তা সরু হওয়ায় অগ্নিকান্ডে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলাচলেও বিঘ্ন ঘটবে।
তবে দীর্ঘদিনেও অভিযোগের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সিডিএ কর্তৃপক্ষ। বরং বিষয়টি ধামাচাপা দিতে গত ২০২১ সালের ৬ জুন ভবনটির সংশোধনী নকশার জন্য আবেদন করে স্যানমার প্রপার্টিজ। তার বিপরীতে একই বছরের ৮ জুন নির্মাণাধীন এ ভবনের ক্ষতিকর বিষয়গুলো উল্লেখ করে এসএ গ্রুপের চেয়াম্যান মো. শাহাবুদ্দীন আলমের পক্ষে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন সৈয়দ রাফিদুল আলম। মামলায় আদালত কর্তৃক সমন জারির পরও নির্মাণকাজ পরিচালনা করায় একই বছরের ১৯ জুন নগরের খুলশী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করা হয়। এর আগে করোনাকালে সরকারি বিধিনিষেধ না মেনে নির্মাণকাজ পরিচালনা করায় একই বছরের ২৯ এপ্রিলও একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয় আবাসন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
এদিকে ২০২১ সালের ২৩ জুন মামলা চলমান থাকায় সংশোধনী নকশার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে সিডিএর চিফ প্ল্যানার বরাবর আবেদন করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২, ইমারত নির্মাণ আইন ২০০৮, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন ২০০৩, সিভিল এভিয়েশন আইন, সিডিএ আইন ২০০৮ এ বিধিমালা লঙ্ঘন করে এ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। তাছাড়া ঝুঁকির বিষয়গুলোও উল্লেখ করা হয়েছে। একই দিনে অভিযোগ করা হয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর। এর আগের দিন অর্থাৎ ২২ জুন পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের বিষয়ে অভিযোগ করা হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক বরাবর। প্রতিটি অভিযোগেই স্যানমার প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম মাসুক হক, প্রজেক্ট ম্যানেজার সেলিম বিন সালেহ, প্রজেক্ট ডিরেক্টর সফিকুর রহমান, ম্যানেজার (এডমিন) মো. মাইনুল হক ও এডমিন ম্যানেজার এহসানুল বারীকে দায়ী করা হয়।
কিন্তু এতো অভিযোগেও কোনো ফল পায়নি স্থানীয় বাসিন্দারা। চলতি বছরের ৫ জুলাই আদালতের রায়ে মাত্র ২১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে ১২ তলা ভবন নির্মাণকাজ পরিচালনা করছে এ আবাসন প্রতিষ্ঠান। এতে মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কার কোন সুরাহা হয়নি। এছাড়া একই বছরের ১২ আগস্ট মামলা চলাকালে সংশোধনী নকশার আবেদন অনুমোদন না করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিডিএ চেয়ারম্যান, সচিব, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, চিফ প্ল্যানার, অতিরিক্ত চিফ প্ল্যানার, অথরাইজড অফিসার-১ মোহাম্মদ হাসান ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু এতেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
আদালত কর্তৃক রায়ের একই দিনে রিভিশন মামলা করা হয়। এ মামলায় আগামি ২০ অক্টোবর শুনানি হবে আদালতে। এর আগে ২৮ জুন হাইকোর্টে এ ঝুঁকির বিষয়ে রিট মামলা করা হয়। কোর্টের ভ্যাকেশন শেষে এ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করেই নির্মাণকাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে মামলা চলাকালীন সময়ে গত ২৩ জুন চারটি বেসমেন্টসহ ৮ তলা ভবনের রিভাইস প্ল্যান অনুমোদন করে সিডিএ।
পরে ২০২২ সালের ১ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন মোহাম্মদ পারভেজ হোসেন। সেখানে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, স্যানমার প্রপার্টিজ সিডিএ সংশ্লিষ্ট অথরাইজড অফিসারসহ প্ল্যানিং বিভাগের কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের অবৈধভাবে লাভবান করে ৬ তলা প্ল্যান নিয়ে ১২ তলা প্ল্যান বহির্ভূত ভবন নির্মাণ করেন। স্থানীয় লোকজন আপত্তি ও অভিযোগ করার পরও অবৈধ ও অন্যায় কাজকে বৈধতা দেওয়ার জন্য চলতি বছরের ২৩ জুন স্যানমার প্রপার্টিজের কথামত চারটি বেইসমেন্টসহ ৮ তলা ভবনের অনুমোদন দেয় সিডিএ।
অভিযোগে আরও জানানো হয়, ছাড়পত্র নেওয়া অংশের চেয়ে বেশি পরিমাণ পাহাড় কেটে নির্মিত ভবনটি যেকোন মুহূর্তে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ভবন নির্মাণে ইমারত নির্মাণ আইন ও বিধিমালা, ফায়ার আইন, পরিবেশ আইন, সিভিল এভিয়েশন আইনগুলো লঙ্ঘন করা হয়েছে। তারপরও সিডিএ অথরাইজড অফিসার-১ এবং অতিরিক্ত চিফ প্ল্যানার অবৈধ ভবনটিতে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর ডানকান হিলে আরফিন নগরের পাহাড় কেটে সিডিএকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে প্ল্যান নিয়ে ভবন নির্মাণ করে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করছে স্যানমার প্রপার্টিজ।
এতে অভিযোগ করা হয়, প্রতিষ্ঠানটির মালিক এম মাসুক হক তার অবৈধ আয় দুবাইতে বেআইনিভাবে পাচার করে অবৈধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। মূলত চট্টগ্রামের বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের গ্রাহক থেকে নেওয়া টাকাই দুবাইতে পাচার করা হয়েছে বলেও অভিযোগে বলা হয়।
অভিযোগকারী মোহাম্মদ পারভেজ হোসেন বলেন, ‘স্যানমারের ভবনের অবৈধ অংশ ভেঙে ফেলা হোক। যা আশপাশের জনমালের জন্য খুবই বিপজ্জনক। তাছাড়া এ আবাসন প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য প্রকল্পে পরিবেশের ও জানমালের যে সকল ক্ষতি সাধন করা হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণসহ ভবনগুলো দ্রুত অপসারণের ব্যবস্থা করা হোক।’
এ বিষয়ে জানতে সিডিএর অথরাইজড অফিসার-১ মোহাম্মদ হাসানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
সিপি