চট্টগ্রামের স্বর্ণবার ঢাকা যাচ্ছে— ফেনীর ডিবিকে খবরটি দেন হাজারী গলিরই ব্যবসায়ী

১৫ স্বর্ণবারের ১০টিই এসেছে মিয়ানমারের চোরাইপথে

নতুন মোড় নিয়েছে চট্টগ্রামের হাজারী গলির ব্যবসায়ীর ২০টি স্বর্ণবার ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা। দৃশ্যপটে এবার চট্টগ্রামেরই আরেক স্বর্ণব্যবসায়ী হাজির, যিনি একইসঙ্গে ‘পুলিশের সোর্স’ও। নাম তার ছমদুল হক ভুট্টু।

রোববার (১৫ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুল হাসানের আদালতে চট্টগ্রামের স্বর্ণব্যবসায়ী ছমদুল হক ভুট্টু ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দিয়েছেন বিস্ফোরক সব তথ্য।

আবার ছমদুল হক ভুট্টু যেদিন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, সেদিন থেকেই মামলার বাদী চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাশ ‘আত্মগোপনে’ রয়েছেন। ওইদিন থেকে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি তালাবদ্ধ। ব্যবহৃত মোবাইলটিও বন্ধ। গোপাল কান্তি দাস চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী লেনের ইকুইটি কোহিনূর মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ‘আলো জুয়েলার্সে’র স্বত্বাধিকারী। তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায়।

গত ৮ আগস্ট বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজের সামনে ফেনী গোয়েন্দা পুলিশের ৬ কর্মকর্তা চট্টগ্রামের স্বর্ণব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাসের কাছ থেকে ২০টি সোনার বার ছিনতাই করেন। এই ২০টি স্বর্ণের বারের মোট ওজন ২ কেজি ৩৩০ গ্রাম। যার বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৬ টাকা। অভিযুক্ত এই ছয় পুলিশ সদস্য হলেন— ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি সাইফুল ইসলাম, এসআই মোতাহার হোসেন, নুরুল হক ও মিজানুর রহমান এবং এএসআই অভিজিৎ বড়ুয়া ও মাসুদ রানা। ঘটনার পর তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করার পর চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ফেনী মডেল থানা পুলিশ ঘটনার পর পরই ছিনতাই হওয়া ২০টি বারের মধ্যে ১৫টি বার উদ্ধার করে ওসি সাইফুল ইসলামের বাসার আলমারি থেকে।

এদিকে এই ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে শনিবার (১৪ আগস্ট) রাতে চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও ‘পুলিশের সোর্স’ ছমদুল হক ভুট্টুকে চট্টগ্রাম থেকে আটক করে পুলিশ। পরে তাকে ফেনী মডেল থানায় এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ছমদুল হক ভুট্টু তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও ২০টি স্বর্ণবার ডাকাতি মামলার বাদী গোপাল কান্তি দাশ এক সময়ে তার ব্যবসায়িক অংশীদার ছিল। গোপাল ২৭টি স্বর্ণবার নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন এই তথ্যটি তিনি (ভুট্টু) একজনকে জানিয়েছিলেন। যাকে তিনি এ তথ্যটি জানিয়েছিলেন সেই ব্যক্তি ফেনী জেলা গেয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসির সোর্স হিসেবে কাজ করেন।

ওই সোর্স ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম ভূইয়াকে জানিয়ে দেন স্বর্ণবারগুলো গোপাল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে যাচ্ছেন। সোর্সের সেই তথ্যে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাশের গাড়ি আটকে তল্লাশি করে। ডিবি পুলিশ সে সময়ে গাড়ি তল্লাশি করে ১৫টি স্বর্ণবার পেলেও লুকায়িত অবস্থায় ১২টি স্বর্ণবার ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাশের গাড়িতে থেকে যায়।

পরে গোপাল কান্তি দাশ চট্টগ্রামে ফিরে তার সাবেক ব্যবসায়িক অংশীদার ছমদুল হককে বিষয়টি জানান। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ছমদুল আরও জানান, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া বেশিরভাগ স্বর্ণবার কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে আনা হয়।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) বরখাস্ত পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম ভূইয়ার বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ১৫টি স্বর্ণের বারের মধ্যে ১০টি মিয়ানমার ও অপর পাঁচটি দুবাই থেকে আনা হয়েছে। স্বর্ণবারগুলোর গায়ে ওইসব দেশের নাম রয়েছে। এর বাইরে লুট হওয়া অপর পাঁচটি সোনার বারের হদিস এখনও পায়নি পুলিশ। তবে মামলার বাদী ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাশ মামলা করার সময় দাবি করেছিলেন, লুট হওয়া সবকটি সোনার বার দুবাই থেকে আমদানি করা হয়েছে।

এদিকে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মামলার বাদী চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাশ গত শনিবার থেকে ‘আত্মগোপনে’ রয়েছেন। ওইদিন থেকে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে গিয়ে পুলিশ তালাবদ্ধ অবস্থায় পেয়েছে। তার ব্যবহৃত মোবাইলও বন্ধ।

চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, রোববার (৮ আগস্ট) বিকেল পৌনে ৪টার দিকে একটি প্রাইভেট কারে করে চট্টগ্রাম থেকে ২০ পিস স্বর্ণের বার নিয়ে অলঙ্কার তৈরির জন্য ঢাকার তাঁতিবাজারের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। যাত্রাপথে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ফেনী মডেল থানার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজের সামনে পৌঁছালে ওয়্যারলেস ও পিস্তলসহ গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেট পরিহিত চারজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি তার গাড়ি থামাতে সিগন্যাল দেয়।

তিনি বলেন, গাড়ি থামানোর পরই জ্যাকেট পরিহিত তিনজন গাড়ির ভেতরে ঢোকে। গাড়ির ভেতরে থাকা একজন পুলিশ ওই ব্যবসায়ীর মাথায় পিস্তল ধরে ও অন্য আরেকজন গাড়ি চালক শওকতকে বেধম মারধর করে। মারধরের একপর্যায়ে তারা নিজেদের ফেনী ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘তোদের কাছে অবৈধ মালামাল আছে, তাড়াতাড়ি বের কর।’

‘তখন অবৈধ মালামাল না থাকার বিষয়টি জানিয়ে আমার কাছে থাকা ২০ পিস বৈধ স্বর্ণের কথা জানাই। তখন তারা ‘ডিবির ওসি স্যার আসতেছে, উনি এলে বিস্তারিত আলাপ হবে’— এমন কথা বলে। এভাবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট চলার পর সাদা রঙের একটি গাড়িতে সাদা পোশাকে একজন কর্মকর্তা আসতেই তারা জোর করে আমাকে ওই গাড়িতে উঠায়। এছাড়া যারা সিগন্যাল দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল, তাদের ছিল নীল রঙের আইআরএক্স হায়েস।’

গোপাল কান্তি দাস জানান, গাড়িতে ওঠানোর পর ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা স্বর্ণের বারগুলো দেখতে চাইলে তাকে দেখানো মাত্র তিনি কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেন, ‘তোর কাছে যতই বৈধ কাগজপত্র থাকুক না কেন এ মুহূর্তে তোকে ক্রসফায়ারে দেব অথবা ৫০০ থেকে ৭০০ পিস ইয়াবা দিয়ে চালান দেব।’ তখন আমি ভয় পেয়ে তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে তারা বলে, ‘স্বর্ণের বারগুলো তো পাবিই না, তোর এই গাড়ি, ড্রাইভার ও তোর নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ১ কোটি টাকা দিতে হবে।’

চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী আরও জানান, ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ফ্লাইওভারের নিচে রেলগেট সংলগ্ন নির্জন এলাকায় নিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে তারা। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে তারা আমাকে দিয়ে এটা বলতে বাধ্য করে যে, ‘আমার কাছে তারা ১২ পিস স্বর্ণের বার পেয়েছে যার বৈধ কাগজ দেখালে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।’ একই সঙ্গে আমার দেওয়া বক্তব্য জোর করে ভিডিও ধারণ করে এবং ঘটনাটি কারও কাছে প্রকাশ করলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস বলেন, গাড়িটি থামার পর তারা চোখ খুলে দিলে গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটি বারইয়ারহাট (মিরসরাই) দেখতে পাই। ওই সময় তারা আবারও আগের মতো জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও ধারণ করে। সবশেষে রাত প্রায় সোয়া ৮টার দিকে আমার গাড়িতে চালক শওকতকে তুলে দিয়ে সোজা বাড়ি ফিরে যেতে বলে। ওই সময় তারা বলে, ‘এখানে যা হয়েছে সব ভুলে যাও’। এ ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় তারা।

গোপাল কান্তি দাস পরবর্তী সময়ে গাড়ি নিয়ে সোজা চট্টগ্রামে নিজ বাসায় ফেরেন। চট্টগ্রাম ফিরে স্বজন ও ব্যবসায়ীদের ঘটনা খুলে বলেন। চট্টগ্রাম স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পরামর্শে মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) ফেনী মডেল থানায় হাজির হয়ে বিষয়টি থানার ওসিকে মৌখিকভাবে জানান তিন। তখন ওসি বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ওইদিন দুপুর ১টা ২০ মিনিটে পুলিশ লাইনে কর্মরত ডিবির কর্মকর্তাদের জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় হাজির করলে ডিবির ওসি মো. সাইফুল ইসলাম, এসআই মোতাহের হোসেন, এসআই নুরুল হক ও এএসআই মাসুদ রানাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন ওই ব্যবসায়ী। তাদের রোববারের ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করে এবং বারগুলো ওসি ডিবির বাসায় রয়েছে বলে জানায়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!