ভিডিও/ ময়মনসিংহে হাত-পা বাঁধা চট্টগ্রামের সৌরভ ১১ দিনে ফিরলেন মায়ের বুকে

সকাল ১১টা ৩৩ মিনিটে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের প্রিজন ভ্যানটি ঢাকার বনানী ডিওএইচএসে সোহেল তাজের বাসার সামনে পৌঁছামাত্রই প্রধান ফটকটি খুলে দেওয়া হল। এর ঠিক পিছনেই একটি মাইক্রোবাস এসে থামলো। সোহেল তাজের দৃষ্টি সেদিকে, দ্রুত ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে বললেন তিনি। এক মিনিটের মধ্যেই মাইক্রোবাসটির দরজা খুলে নামলেন একজন পুলিশ সদস্য। তার পিছনেই সৌরভ! নেমেই দুই পা হেঁটে জড়িয়ে ধরলেন মাকে। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। একটু পর একে একে বাবা ও সোহেল তাজকে বুকে জড়িয়ে ধরেন সৌরভ। কারও সঙ্গে কথা বলতে না দিয়েই সৌরভকে নিয়ে তারা বাসার লিফটের দিকে এগিয়ে গেলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ সম্পর্কে সৌরভের মামা।

ময়মনসিংহের তারাকান্দা থেকে উদ্ধার করা হয় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের ভাগ্নে সৌরভকে।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা থেকে উদ্ধার করা হয় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের ভাগ্নে সৌরভকে।

১১ দিন পর এভাবেই সমাপ্তি ঘটলো সৌরভ অপহরণের ঘটনা। এর আগে বৃহস্পতিবার (২০ জুন) ভোর ৫টার দিকে ময়মনসিংহের তারাকান্দার একটি রাইচ মিলের সামনে থেকে উদ্ধার করা হয় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের ভাগ্নে সৌরভকে।

সৌরভের ফিরে আসার পর সোহেল তাজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সৌরভের মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকের পরামর্শও নেওয়া হবে। সৌরভকে মানসিকভাবে কয়েক স্তরে নির্যাতন করা হয়েছে। সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং দুর্বল। তবে কে বা কারা, কী উদ্দেশ্যে অপহরণ করেছিল, তা এখনও বলেনি সৌরভ। সে উদ্ধার হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই আমরা।’

সৌরভের মা সৈয়দা ইয়াসমিন আরজুমানও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। উদ্ধার হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সৌরভ নিজেও। এর বেশি কিছু বলেননি তিনি।

চট্টগ্রামের ছেলে সৌরভের নিখোঁজের ঘটনায় চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন পুলিশ, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কাজ করছিল।

ময়মনসিংহের তারাকান্দা থেকে উদ্ধার করা হয় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের ভাগ্নে সৌরভকে।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা থেকে উদ্ধার করা হয় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের ভাগ্নে সৌরভকে।

যেভাবে উদ্ধার হলেন সৌরভ
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) ভোরে সোহেল তাজ বলেন, ‘সকাল ৫টা ২৭ মিনিটে সৌরভের মা আমাকে ফোন করেন। আর বলেন সৌরভকে কে যেন ফেলে গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। কে বা কারা করছে তা বলতে চাচ্ছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজমের উপ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি তাৎক্ষণিক সেই এলাকার এসপি (পুলিশ সুপার) সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এসপি সাহেব নিজে গিয়ে সেই লোকেশন থেকে সৌরভকে পুলিশ কাস্টডিতে (হেফাজতে) নেয়। সৌরভ এখন পুলিশ কাস্টডিতে সেফ (নিরাপাদ) আছে। ওকে এখন পুলিশি পাহারায় আমাদের কাছে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।’

সোহেল তাজ বলেন, ‘সৌরভকে যখন পাওয়া যায় তখন তার হাত-পা বাঁধা ছিল। গায়ে কোনও জামা ছিল না, শুধু পায়জামা পরা ছিল। তার চোখ বাঁধা ছিল। ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার তাকে বাসায় নিয়ে গোসলের ব্যবস্থা করেন এবং কিছু খাবার দেন। উদ্ধারের পর সৌরভ বুঝেই উঠতে পারেনি সে কোথায়।’

সোহেল তাজ বলেন, ‘সে মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত। এখন তাকে চাপমুক্ত রাখতে চাই। আমরা তাকে একটু স্বস্তিতে রাখতে চাই। সৌরভ আভাসে ইঙ্গিতে কিছুটা জানিয়েছে, সে কী পরিস্থিতিতে ছিল। তবে এখন তার ওপর কোনও চাপ দেওয়া যাবে না। আমরা তার অপেক্ষায় আছি।’

এদিকে বৃহস্পতিবার (২০ জুন) সকাল ৯টায় ময়মনসিংহ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এব সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন বলেছেন, ‘বৃহস্পতিবার (২০ জুন) ভোর ৫টা ২০ মিনিটের সময় ময়মনসিংহ শেরপুর রুটের তারাকান্দার মধুপুর বটতলা এলাকার জামিল অটোরাইস মিলের সামনে দুর্বৃত্তরা সৌরভকে ফেলে রেখে যায়। ওই রাইস মিলের কর্মচারী সৌমিক ফোনে সৌরভের পরিবারকে খবর দেয়। পরিবার ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম কর্তৃপক্ষকে জানায়। পরে খবর পেয়ে তারাকান্দা থানা পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে সৌরভকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নিয়ে আসে। পুলিশ সুপার আরও জানান, সৌরভ সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পুলিশি হেফাজতে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’

জামিল অটো রাইস মিলের ম্যানেজার কাঞ্চন ও ফোরম্যান সমির জানান, ‘আমরা ভোরে ঘুমিয়েছিলাম। এসময় কান্নাকাটির শব্দ শুনতে পাই। ঘর থেকে বের হয়ে দেখি এক লোককে গাড়ি থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দ্রুত গাড়ি নিয়ে চলে গেল কিছু লোক। লোকটি অনেকটা বিপর্যস্ত। সে জানায় তার নাম সৌরভ। সে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের ভাগ্নে। এ কথা বলার পর আমি বিষয়টি মিল মালিক হিজবুল বাহার খান বাচ্চুকে জানাই। মিল মালিক বিষয়টি পুলিশকে জানানোর কথা বলেন। এ সময় আমরা উনাকে নিয়ে মিলের ভেতরে নিয়ে একটি চেয়ারে বসাই। পরে সৌরভ তার পরিবারের একটি মোবাইল নাম্বার দিলে ম্যানেজার কাঞ্চন বিষয়টি পরিবারকে জানান। পরিবার পরে বিষয়টি চট্টগ্রাম অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটকে জানায়।’

যেভাবে নিখোঁজ হয়ে যান সৌরভ
সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভ ৯ জুন চট্টগ্রাম প্রবর্তক মোড়ের আফমি প্লাজার সামনে থেকে নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় সৌরভের বাবা ইদ্রিস আলম বাদি হয়ে ১০ জুন সোমবার পাঁচলাইশ থানায় একটি জিডি (৫২০) দায়ের করেন। জিডিতে তিনি সৌরভকে অপহরণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

ওইদিন চাচাতো ভাইয়ের মোটর বাইকে চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ের আফমি প্লাজার সামনে আসেন সোহেল তাজের ভাগ্নে সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভ। সেখান থেকে নিখোঁজ হন তিনি। সৌরভের বাবা ইদ্রিস হোসেন বাদি হয়ে পরদিন সোমবার পাঁচলাইশ থানায় একটি জিডি করেছেন। জিডিতে তিনি সৌরভকে অপহরণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

প্রবর্তক মোড়ের আফমি প্লাজার নিচতলায় অবস্থিত এগোরা সুপারশপের সিসি ক্যামেরায় সৌরভের অবস্থান দেখা গেছে। পাঁচ মিনিট পর একটি কল রিসিভ করে এফমি প্লাজার পেছনে যান সৌরভ। এখান থেকেই পাঁচ ব্যক্তি কালো প্রাডোতে তুলে অন্যত্র নিয়ে যান সৌরভকে। এসময় সৌরভের হাতে একটি সাদা খাম ছিল।

সৌরভের চাচাতো ভাই সাহেদুর রহমান জানান, হাতে থাকা খামে সৌরভের সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) ছিল। চাকরি দেওয়ার কথা বলে সৌরভকে ডাকা হয়েছিল। চাচাতো ভাই সাহেদুরই সৌরভকে মোটরসাইকেলে এনে আফমি প্লাজার সামনে নামিয়ে দেন। তখন সৌরভ তাকে জানিয়েছিলেন, ১০-১৫ মিনিট পরে আবার ফোন করবেন, তখন এসে তাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ১৫ মিনিট পরে আর ফোন করেননি সৌরভ। কল দিলে মোবাইল বন্ধ পান সাহেদুর।

১৪ জুন শুক্রবার দিবাগত রাত একটার দিকে সোহেল তাজ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে অভিযোগ করেন তাঁর ভাগ্নেকে অপহরণ করা হয়েছে। ভাগ্নের ছবিসহ ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে সোহেল তাজ লিখেছেন, ‘আমার মামাতো বোনের ছেলে (ভাগিনা) সৈয়দ ইফতেখার আলম প্রকাশ সৌরভকে গত রবিবার ৯ জুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হসপাতালের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়েছে। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদেরকে অনুরোধ করছি সৌরভকে ফিরিয়ে দিতে তার পরিবারের কাছেও অন্যথায় আপনাদের পরিচয় জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। ঘটনার আড়ালে কারা আছেন তা আমরা জানিও।’

এরপর সোমবার (১৭ জুন) দুপুর ২টার দিকে ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর–রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে নিখোঁজ সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান মামা সোহেল তাজ। এর জন্য প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে সোহেল তাজের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সৌরভের মা সৈয়দা ইয়াসমিন আরজুমান ও বাবা মো. ইদ্রিস আলম।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!