চট্টগ্রামের সেই স্বর্ণব্যবসায়ীর মামলার এজাহার পাল্টে দিল পুলিশ

ছিনতাইকারী ৬ পুলিশকে ‘সুবিধা’ করে দেওয়াই লক্ষ্য

0

চট্টগ্রামের স্বর্ণব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাসের কাছ থেকে ২০টি সোনার বার ছিনতাইয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত ফেনী গোয়েন্দা পুলিশের ৬ কর্মকর্তাকে অভিযোগ থেকে রেহাই পাইয়ে দেওয়ার পথ তৈরি করা হচ্ছে— এমন অভিযোগ উঠেছে। এমনকি মামলার এজাহার পরিবর্তন করে ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের ‘সুবিধা’ করে দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ৮ আগস্ট বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজের সামনে ফেনী গোয়েন্দা পুলিশের ৬ কর্মকর্তা চট্টগ্রামের স্বর্ণব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাসের কাছ থেকে ২০টি সোনার বার ছিনতাই করেন। এই ২০টি স্বর্ণের বারের মোট ওজন ২ কেজি ৩৩০ গ্রাম। যার বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৬ টাকা।

অভিযুক্ত এই ছয় পুলিশ সদস্য হলেন— ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি সাইফুল ইসলাম, এসআই মোতাহার হোসেন, নুরুল হক ও মিজানুর রহমান এবং এএসআই অভিজিৎ বড়ুয়া ও মাসুদ রানা। ঘটনার পর তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করার পর চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ফেনী মডেল থানা পুলিশ ঘটনার পর পরই ছিনতাই হওয়া ২০টি বারের মধ্যে ১৫টি বার উদ্ধার করে ওসি সাইফুল ইসলামের বাসার আলমারি থেকে।

s alam president – mobile

এদিকে ফেনীতে একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ২০টি সোনার বার লুটের ঘটনায় ডিবির ওসি সাইফুল ইসলাম ও তার পাঁচ সহযোগী ১৭ দিনের রিমান্ডেও কোনো তথ্য বা স্বীকারোক্তি দেননি। ২০টি সোনার বারের ১৫টি ঘটনার সময় উদ্ধার হলেও বাকি পাঁচটি সোনার বার এখনও উদ্ধার হয়নি।

এই মামলার বাদী গোপাল কান্তি দাস এখন আতঙ্কে আছেন। গোপাল কান্তি দাস চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী লেনের ইকুইটি কোহিনূর মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ‘আলো জুয়েলার্সে’র স্বত্বাধিকারী। তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায়।

গোপাল কান্তি দাস অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তার এজাহার পরিবর্তন করে দিয়েছে। তিনি যে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সেটা এজাহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি। পুলিশ ঘটনার সময় আরও কয়েকটি কাগজে সই নিয়েছিল— এই দাবি করে গোপাল বলেন, ‘সেখানে পুলিশের নিজের লেখা একটি এজাহার ছিল। থানা সেটাই রেকর্ড করেছে। তাতে অনেক তথ্যের গরমিল রয়েছে। অনেক অভিযোগ বাদ দেওয়া হয়েছে। আমি এখন আশঙ্কা করছি মামলাটি দুর্বল করে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সুবিধা দিতেই অন্য পুলিশ সদস্যরা এই কাজ করেছে।’

Yakub Group

গোপাল কান্তি দাস বলেন, ‘আমি ডিআইজি সাহেবের আশ্বাসে অভিযোগ দিয়েছিলাম। নয়তো আমার সাহস ছিল না পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করার। কয়েকদিন আগে এজাহার পরিবর্তনের বিষয়টি জানার পর আমি ডিআইজি সাহেবকেও জানিয়েছি৷’

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন তার এই অভিযোগের জবাবে বলেন, ‘তিনি শুরুতে মামলাই করতে চাননি। আমার অনুরোধে মামলা করেছেন। তিনি আমার কাছে এসে পরে অভিযোগ করেছেন যে, তার এজাহার রেকর্ড করা হয়নি। পুলিশ তাদের মতো এজাহার করেছে।’

ডিআইজি আনোয়ার বলেন, ‘এখন মামলা তদন্ত করছে পিবিআই। আমি তাকে পিবিআইর কাছে নতুন করে অভিযোগ লিখে দিতে বলেছি। সেটাই গ্রহণ করা হবে।’

চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, রোববার (৮ আগস্ট) বিকেল পৌনে ৪টার দিকে একটি প্রাইভেট কারে করে চট্টগ্রাম থেকে ২০ পিস স্বর্ণের বার নিয়ে অলঙ্কার তৈরির জন্য ঢাকার তাঁতিবাজারের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। যাত্রাপথে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ফেনী মডেল থানার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজের সামনে পৌঁছালে ওয়্যারলেস ও পিস্তলসহ গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেট পরিহিত চারজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি তার গাড়ি থামাতে সিগন্যাল দেয়।

তিনি বলেন, গাড়ি থামানোর পরই জ্যাকেট পরিহিত তিনজন গাড়ির ভেতরে ঢোকে। গাড়ির ভেতরে থাকা একজন পুলিশ ওই ব্যবসায়ীর মাথায় পিস্তল ধরে ও অন্য আরেকজন গাড়ি চালক শওকতকে বেধম মারধর করে। মারধরের একপর্যায়ে তারা নিজেদের ফেনী ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘তোদের কাছে অবৈধ মালামাল আছে, তাড়াতাড়ি বের কর।’

‘তখন অবৈধ মালামাল না থাকার বিষয়টি জানিয়ে আমার কাছে থাকা ২০ পিস বৈধ স্বর্ণের কথা জানাই। তখন তারা ‘ডিবির ওসি স্যার আসতেছে, উনি এলে বিস্তারিত আলাপ হবে’— এমন কথা বলে। এভাবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট চলার পর সাদা রঙের একটি গাড়িতে সাদা পোশাকে একজন কর্মকর্তা আসতেই তারা জোর করে আমাকে ওই গাড়িতে উঠায়। এছাড়া যারা সিগন্যাল দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল, তাদের ছিল নীল রঙের আইআরএক্স হায়েস।’

গোপাল কান্তি দাস জানান, গাড়িতে ওঠানোর পর ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা স্বর্ণের বারগুলো দেখতে চাইলে তাকে দেখানো মাত্র তিনি কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেন, ‘তোর কাছে যতই বৈধ কাগজপত্র থাকুক না কেন এ মুহূর্তে তোকে ক্রসফায়ারে দেব অথবা ৫০০ থেকে ৭০০ পিস ইয়াবা দিয়ে চালান দেব।’ তখন আমি ভয় পেয়ে তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে তারা বলে, ‘স্বর্ণের বারগুলো তো পাবিই না, তোর এই গাড়ি, ড্রাইভার ও তোর নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ১ কোটি টাকা দিতে হবে।’

চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী আরও জানান, ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ফ্লাইওভারের নিচে রেলগেট সংলগ্ন নির্জন এলাকায় নিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে তারা। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে তারা আমাকে দিয়ে এটা বলতে বাধ্য করে যে, ‘আমার কাছে তারা ১২ পিস স্বর্ণের বার পেয়েছে যার বৈধ কাগজ দেখালে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।’ একই সঙ্গে আমার দেওয়া বক্তব্য জোর করে ভিডিও ধারণ করে এবং ঘটনাটি কারও কাছে প্রকাশ করলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস বলেন, গাড়িটি থামার পর তারা চোখ খুলে দিলে গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটি বারইয়ারহাট (মিরসরাই) দেখতে পাই। ওই সময় তারা আবারও আগের মতো জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও ধারণ করে। সবশেষে রাত প্রায় সোয়া ৮টার দিকে আমার গাড়িতে চালক শওকতকে তুলে দিয়ে সোজা বাড়ি ফিরে যেতে বলে। ওই সময় তারা বলে, ‘এখানে যা হয়েছে সব ভুলে যাও’। এ ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় তারা।

গোপাল কান্তি দাস পরবর্তী সময়ে গাড়ি নিয়ে সোজা চট্টগ্রামে নিজ বাসায় ফেরেন। চট্টগ্রাম ফিরে স্বজন ও ব্যবসায়ীদের ঘটনা খুলে বলেন। চট্টগ্রাম স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পরামর্শে মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) ফেনী মডেল থানায় হাজির হয়ে বিষয়টি থানার ওসিকে মৌখিকভাবে জানান তিন। তখন ওসি বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ওইদিন দুপুর ১টা ২০ মিনিটে পুলিশ লাইনে কর্মরত ডিবির কর্মকর্তাদের জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় হাজির করলে ডিবির ওসি মো. সাইফুল ইসলাম, এসআই মোতাহের হোসেন, এসআই নুরুল হক ও এএসআই মাসুদ রানাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন ওই ব্যবসায়ী। তাদের রোববারের ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করে এবং বারগুলো ওসি ডিবির বাসায় রয়েছে বলে জানায়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!