চট্টগ্রামের বুকে মরণফাঁদ— মুরাদপুর থেকে হাটহাজারী সড়ক, খালের মুখ খোলা ৫০ ফুট করে

ভেসে যাওয়া লোকটির খোঁজ মেলেনি ৪৮ ঘন্টায়ও

চট্টগ্রামের ব্যস্ততম এলাকা মুরাদপুর মোড় থেকে হাটহাজারী সড়কের মুখে বামপাশের খোলামেলা খালে বুধবার (২৫ আগস্ট) পানির স্রোতে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ। ৫০ বছর বয়সী সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদের এই মৃত্যুকে নিছকই দুর্ঘটনা ভাবতে নারাজ নাগরিকরা। নগর পরিকল্পনাবিদরাও বলছেন, দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় ঘটা এই ঘটনার দায় নিতে হবে তাদেরকেই। মুরাদপুরের মত জায়গায় মূল সড়কের পাশে এভাবে খালের মুখ উন্মুক্ত থাকার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।

স্থানীয়রা বলছেন, এক সময় ওই জায়গাটি স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা থাকলেও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের জন্য বছরখানেক আগে সেসব স্ল্যাব সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর সেখানে কোনো ‘সেইফটি মেজার’ বা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কর্মপদ্ধতিতে বড়সড় গলদ থাকার কথাও বলছেন কেউ কেউ। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে চলা জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালে অবৈধ দখল অপসারণের অংশ হিসেবে সেখানে খালের ওপরের স্ল্যাব সরিয়ে নিলেও এখনও সেখানে কোন রকমের কাজ শুরু করা হয়নি। ফলে ‘সেইফটি মেজার’ নেওয়ার বিষয়টি এখনও প্রাসঙ্গিক নয়।

সালেহ আহমদের তলিয়ে যাওয়ার যে ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎই পা ফসকে নিচের দিকে তলিয়ে যান তিনি। যে অংশে এই ঘটনা ঘটে সেটি হচ্ছে মূলত হাটহাজারী সড়কের বাম পাশে। হাটহাজারী রোড থেকে বামপাশে আয়োজন রেস্তোরাঁর দিকে যাওয়ার পথে পা ফসকে খালের পানিতে তলিয়ে যান তিনি।

চট্টগ্রামের বুকে মরণফাঁদ— মুরাদপুর থেকে হাটহাজারী সড়ক, খালের মুখ খোলা ৫০ ফুট করে 1

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মূল মোড়ের সাথে লাগোয়া ওই খালের দুই পাশেই প্রায় ৫০ ফুট করে অংশ একেবারেই উন্মুক্ত। ঘটনার দিন সেখানে কোনো রেলিং বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি সতর্কতামূলক কোনো সাইনবোর্ডও নয়। সামান্য বৃষ্টিতেই যেখানে মুরাদপুরের ওই অংশে পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে যায়, সেখানে চলাচলের পথে পথচারী তো বটেই যানবাহনগুলোও পানির ভেতরে তলিয়ে গিয়ে এমন বিপদের ঝুঁকিতে ছিল— এমনটাই দেখা গেছে ঘটনাস্থল ঘুরে।

এমন ঝুঁকির বিষয়টি কি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নজরে ছিল না— এই প্রশ্নও এখন বেশ জোরালোভাবে উঠছে। তবে এর জন্য জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে স্থানীয় সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর জেসমিন পারভীন জেসি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখানে তো আগে এমন খোলা ছিল না। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর নালার ওপরের স্ল্যাবগুলো সরিয়ে এটা করা হয়েছে। যেহেতু সেনাবাহিনীর সদস্যরা এগুলো সরিয়েছেন সেহেতু তাদেরই দায়িত্ব ছিল এখানে আশেপাশে রেলিং দেওয়া বা কোন ঘেরা দেওয়া। আমরা মেয়র মহোদয়ের মাধ্যমে এটি সিডিএ ও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের দায়িত্বশীলদের নজরে আনবো।’

ঘটনার পরপরই নিখোঁজ হওয়া সালেহ আহমদকে উদ্ধার করতে ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া এই নারী কাউন্সিলর অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন , ‘অতিবৃষ্টিজনিত পানির কারণে রাস্তার পানি আর সিডিএর চলমান মেগা প্রকল্প ড্রেনের পানি সমান হয়ে গেলে অসাবধানে একজন ব্যক্তি ড্রেনে পড়ে যায় এবং তাৎক্ষণিক পানির স্রোতে বিলীন হয়ে যায়।’

চট্টগ্রামের বুকে মরণফাঁদ— মুরাদপুর থেকে হাটহাজারী সড়ক, খালের মুখ খোলা ৫০ ফুট করে 2

তবে ওই ব্যক্তির অসাবধানতায় ঘটনাটি ঘটেছে— এই বিষয়টি মানতে চাইছেন না অনেকেই। জেসির ওই পোস্টেই রিফাত মাহমুদ নামে একজন জেসিকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘আন্টি দায়ভারটা পড়ে যাওয়া ব্যক্তিটির ওপর দিয়ে দিলেন সিম্পলভাবে! আপনাদের দায় নেই এখানে? জনগণের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব আপনাদের। বিগত দিনে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে আপনারা মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, কিন্তু জনগণ এসবের সুফল আজও পায় না। সিটি কর্পোরেশন এবং সিডিএর কোন কাজে সমন্বয় নেই— যা আমাদের কে হতাশ করে।’

শুধু রিফাত নয় সালেহ আহমেদের এই ঘটনাকে দুর্ঘটনা মানতে রাজি নন নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়াও। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘এর আগে রাস্তার পাশে খালে পড়ে সিএনজিতে চড়া মানুষ মারা গেল। এমন ঘটনা আরও ঘটেছে। এটাকে কিভাবে দুর্ঘটনা বলা যায়? রাস্তার পাশে এভাবে খালের মুখ খোলা কেন থাকবে? এছাড়া এখানে যেহেতু একটা বড় প্রকল্পের কাজ চলছে, সেহেতু সেইফটি মেজার নেওয়া তো বাধ্যতামূলক ছিল। এখানে রেলিং করে দেওয়া যেত। সেটা না পারলে অন্ততপক্ষে সতর্কতা নির্দেশনা সম্বলিত সাইনবোর্ড দেওয়া যেত। কিন্তু সেসবের কিছুই করা হয়নি।’

এই ঘটনায় তবে কারা দায়ী— এমন প্রশ্নে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের এই সহ সভাপতি বলেন, ‘অবশ্যই ওই জায়গাটি এখন যাদের তত্ত্বাবধানে আছে, তাদের দায় নিতে হবে। যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই অংশে কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা এর দায় এড়াতে পারেন না।’

এভাবে খালের মুখ খোলা রাখা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকা নিয়ে উঠা এসব প্রশ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগ্রেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘খাল বা নালার ওপর তো কোন স্ল্যাব থাকবে না। স্ল্যাব থাকাটাই তো অন্যায়। আর সব খালের ওপরের অংশ খোলা থাকবে— এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। এছাড়া সেখানে কোন স্ল্যাবই আমরা সরাইনি। প্রকল্পের অংশ হিসেবে আমরা খালগুলোকে দখলমুক্ত করার সময় সব এলাকাতেই অবৈধ দখলদারদের সময় দিয়েছি। তারাই এগুলো সরিয়ে নিয়েছে।’

‘সেইফটি মেজার’ বা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়নি— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওখানে তো আমরা এখনও কাজই শুরু করিনি। আমাদের পরিকল্পনা আছে খালগুলো ওপরে খোলা থাকবে আর নিচেও পাকা হবে না। পাশ দিয়ে আমরা রেলিং করে দেবো।’

এদিকে নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও সালেহ আহমদের সন্ধান এখন পর্যন্ত মেলেনি। আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের দুই টিমের ১২ জন ডুবুরি উদ্ধার কাজ চালাচ্ছেন। সালেহ আহমেদের ভাইয়ের দোকানের পাঁচজন কর্মচারীও নালায় খোঁজ করছেন।

সালেহ আহমদের উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের এক কর্মকর্তা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সালেহ আহমদ যখন নালায় পড়েন,তখন পানির স্রোত ছিল উত্তরমুখী। এই পথটা বহদ্দারহাট পর্যন্ত এক লাইনে গেছে। বহদ্দারহাট থেকে এটি দুই ভাগ হয়ে এক ভাগ গেছে বহদ্দারহাট বাজারের দিকে এবং অন্যটি কর্ণফুলী নদীতে মিলেছে। এখন দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। একটি হলো সালেহ আহমেদের দেহ কর্ণফুলী হয়ে সাগরে চলে গেছে। এমনটা হলে ২ দিন পর হোক ৩ দিন পর হোক লাশটা ভেসে উঠবে। এক্ষেত্রে আমাদের সব জায়গায় বলাও আছে। ভেসে উঠলে আমরা পাব। অন্য আরও একটি সম্ভাবনা রয়েছে যে এই পুরো পথটার কোথাও খাল নালার মধ্যে লাশটা কোন কিছুর সাথে আটকে গেছে। এমনটা যদি হয় তাহলে খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিল। তবে আমরা সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি।’

সালেহ আহমেদ নগরের চকবাজার এলাকায় কাঁচাবাজার ব্যবসা করতেন। তার বাসাও ওই এলাকায়। তিনি ছেলেসহ সেখানে একটি ‘ব্যাচেলর বাসা’য় থাকতেন। বুধবার সকালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভান্ডার দরবার শরিফে যাওয়ার জন্য মুরাদপুরে এসেছিলেন। ওখান থেকে বাসে করে দরবার শরিফে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরের মুরাদপুর এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় পা পিছলে চশমা খালে পড়ে মুহূর্তেই তলিয়ে যান সালেহ আহমেদ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!