চট্টগ্রামের ‘বিদ্রোহী’দের নিয়ে নমনীয় আওয়ামী লীগ, বিবাদ লাগানো নেতাদের শাস্তি চান বিজয়ীরা

চট্টগ্রাম সিটির ভোটে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ নিয়ে শুরুতে আওয়ামী লীগ কঠোর মনোভাব দেখালেও পরে সেই অবস্থান থেকে দৃশ্যত সরে গিয়ে কঠোর কোনো অবস্থানে যায়নি। তবে ভোটের মাঠে অন্তত আটজন ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ দলীয় ও প্রশাসনিক বাধার মুখেও বিজয়ী হওয়ার পর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও এখন তাদের ব্যাপারে অনেকটাই নমনীয়। এদিকে ‘বিদ্রোহী’ তকমা নিয়ে জয়ী হয়ে আসা এসব প্রার্থী বলছেন, মূলত দলকে নয় তারা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চাওয়া ব্যক্তিদের। কয়েকজন নেতার দিকে আঙ্গুল তুলে তারা অভিযোগ করছেন, এই নেতারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে চট্টগ্রাম মহানগরের এলাকায় এলাকায় আওয়ামী লীগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যা দলকেই দুর্বল করার অপচেষ্টা মাত্র।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ষষ্ঠ নির্বাচনে নজিরবিহীনভাবে ৪১ ওয়ার্ডের সব কাউন্সিলর পদেই জয় ঘরে তুলে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। যদিও এর মধ্যে অন্তত আটজন রয়েছেন যারা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে এসেছেন। প্রথমবারের মত দলের ব্যানারে হওয়া এবারের চসিক নির্বাচনে এই ‘বিদ্রোহী’ নিয়েই ছিল যত উত্তাপ।

এবারের নির্বাচনে চার চারটি প্রাণহানির সবগুলোর পিছনেই রয়েছে কাউন্সিলর পদে দলীয় ও বিদ্রোহীর এই উত্তাপ। নির্বাচন শেষে ‘বিদ্রোহী’ তকমা নিয়ে জয়ী হয়ে আসা এসব প্রার্থী বলছেন, মূলত দলকে নয় তারা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন সেসব ব্যক্তিকেই— যারা দলকে সামনে রেখে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছে। আর সেজন্য ওই ব্যক্তিরাই ‘বিদ্রোহী’ বিষয়টিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চসিক নির্বাচনকে উত্তপ্ত করে তুলেছিল।

নির্বাচনে সেসব ব্যক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সফল হওয়ার মধ্য দিয়ে যে বার্তা পাওয়া গেছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে মহানগরের এলাকায় এলাকায় আওয়ামী লীগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও তাদের বিষয়ে গভীরভাবে ভাববার জন্য দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে এসব কাউন্সিলর বলছেন, আগামী দিনগুলোতেও আগের মত দলের হয়ে রাজপথে সরব থাকবেন তারা।

এবারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিষয়ে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হওয়া হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ‘অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচন আলাদা ছিল। এবারই প্রথম কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়েছে। যেটি আগে উন্মুক্ত ছিল। অনেকটা অকারণে আমরা দলীয় সমর্থন পাইনি।’

দলীয় মনোনয়ন না পেয়েও বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করে কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জয়ী হয়ে আসা বিপ্লব নিজের শক্তির জায়গা তুলে ধরে বলেন, ‘যারা দলীয় সমর্থন পেয়েছে তাদের অনেকের মধ্যেই একটা অহংবোধ ছিল যে প্রশাসনিকভাবে তাদের হেল্প করবে, তাদের জিতিয়ে দেওয়া হবে। এই কনফিডেন্সের কারণে সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে তাদের ব্যাপক দূরত্ব ছিল। তারা ধরেই নিয়েছিল যে আর কেউ ইলেকশন করবে না। শুধু তারাই ইলেকশন করবে এবং তারাই ইলেকটেড হবে। কিন্তু আমরা যারা স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছি আমরা জনগণের কাছেই নির্ভরতা খুঁজেছি, দলের প্রতিও আমাদের শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু জয়ের জন্য দলকে ব্যবহার করার মানসিকতা ছিল না আমাদের।’

তবে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসন তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আচরণ না করে পরিস্থিতির নিরিখে কঠোর অবস্থান দেখাতে পেরেছে মন্তব্য করে বিপ্লব বলেন, ‘কিন্তু প্রশাসনের ওপর তাদের (দল সমর্থিত প্রার্থী) যে নির্ভরতা ছিল সেটা সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বরং প্রশাসন সংঘাত এড়ানোর জন্য যা যা ভাল মনে করেছে সেটাই করেছে। এক্ষেত্রে প্রশাসন একটা নিয়ামক ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করেছে।’

বিদ্রোহী ইস্যু নিয়ে দলের চেয়েও কয়েকজন নেতা ব্যক্তিস্বার্থে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন— এমন মন্তব্য করে ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী হয়ে আসা বিদ্রোহী কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম বলেন, ‘দল থেকেই বলা হয়েছে কাউন্সিলর প্রার্থী দলীয় হতে পারে না। কিন্তু অনেকে এটাকে একটু বেশি হাইলাইট করে দেখাতে চেয়েছে। আমরা দলের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান রাখি। আর বহিষ্কারের বিষয়ে প্রচুর আলাপ হয়েছে। নগর আওয়ামী লীগের বৈঠকে তালিকা করে সেসব কেন্দ্রেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাজেই দলের অবস্থান যেভাবে বলা হয়েছে, সেরকমটা হলে তো অনেক আগেই বহিষ্কার করা হতো। এটা মূলত কিছু লোকের বিচ্ছিন্ন এজেন্ডা ছিল।’

কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে কিছু ব্যক্তির ভুল সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সেটাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াকে সফলতা বলেই ভাবছেন নবনির্বাচিত কাউন্সিলর জসিম। তিনি বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে আমরা দলকে চ্যালেঞ্জ করেছি। কিন্তু সেটা তো ঠিক না। আমরা ব্যক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছি। আমরা দলীয় হাইকমান্ডকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি আমাদের সিলেকশনটা স্বচ্ছভাবে হয়নি। আর ভোটের পর দেখা গেল আমাদের কথাই সত্যি। এটাই আমাদের সফলতা।’

তবে যত যাই হোক স্থানীয় পর্যায়ে গায়ের জোরে জনপ্রতিনিধি বানিয়ে দেওয়ার মানসিকতা যেসব নেতার, তাদের বিষয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নবনির্বাচিত কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো জনগণের স্বার্থের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এগুলোর বিষয়ে একেবারে স্থানীয় পর্যায় থেকেই মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তা না করে কাউকে বানিয়ে দিলাম কিংবা নাম দিয়ে দিলাম— এসব মানসিকতার লোকদের বিষয়ে দলের ভাবা উচিত। এটা আমার একটা দাবি।’

বিপ্লব বলেন, ‘যারা এই ষড়যন্ত্রগুলো করেছে, তারা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থে প্রত্যেকটা এলাকায় দুই গ্রুপ করে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই ষড়যন্ত্রকারীরা। এদের ব্যাপারে দলের ভাবা উচিত।’

তবে দিন শেষে এসব চক্রান্তকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে জনগণের বিজয় হয়েছে মন্তব্য করে ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাহেদ ইকবাল বাবু বলেন, ‘আমরা আগেও আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলাম। এখনও আছি। আমাদের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে। আমরা সেই ষড়যন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি দলকে শক্তিশালী করার স্বার্থেই। দলের প্রশ্নে আমাদের ন্যূনতম আপস ছিল না। যেখান যেখানে আমরা নিজের জন্য ভোট চাইতে গিয়েছি সেখানেই আমরা নিজের প্রতীকের আগে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়েছি।’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!