চট্টগ্রামের পলাতক নেতাদের বেশিরভাগই ভারতে, রাতের মাঝিরঘাটে হঠাৎ নওফেল

রেজাউল-নাছির চট্টগ্রামেই, লিটন দুবাই ও বাচ্চু পর্তুগালে

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনগুলোর বহু নেতা বিভিন্নভাবে ভারতে পালিয়ে গেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া ও তার ভাই চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক বিদ্যুৎ বড়ুয়া, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদও ‘চুক্তি’র ভিত্তিতে সীমান্ত পথে ভারতে ঢোকার পরই জার্মানি হয়ে বেলজিয়ামে চলে গেছেন। তাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার শীর্ষ নেতাদেরও অনেকে ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।

তবে এখনও দেশের ভেতরেই আছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন। তিনি একটি লাইটার জাহাজে করে গভীর সাগরে লুকিয়ে আছেন— এমন খবর রটেছিল মাঝখানে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী গত ৫ আগস্টের পর থেকে চট্টগ্রাম নগরীর ভেতরে বায়েজিদ এলাকার একটি সুরক্ষিত স্থানে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে সিটি কর্পোরেশনে তার ঘনিষ্ঠ কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগও হচ্ছে তার— জানা গেছে এমনও।

এদিকে সর্বশেষ গত রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে একসঙ্গে দেখা গেছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার ভাই চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক বিদ্যুৎ বড়ুয়া এবং চাঁদপুরের এক সাবেক সংসদ সদস্যকে। চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া বারাসাতের বাসিন্দা জুয়েল দের বাড়িতে তারা বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন।

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ৭ আগস্ট ‘চুক্তি’র ভিত্তিতে বেনাপোলের পার্শ্ববর্তী একটি সীমান্ত পথ দিয়ে ভারতে পালিয়েছেন— এমন তথ্য মিলেছে একটি সূত্রে।

গত ২৩ আগস্ট মধ্যরাতে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে মেঘালয়ের শিলং পাহাড় পার হয়ে ভারতে ঢোকেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না ও আওয়ামী লীগের উপকমিটির সহ-সম্পাদক মনিরুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন। তবে মেঘালয়ের শিলং পাহাড়ে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে সেখানেই মারা যান ইসহাক আলী খান পান্না।

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বড় বড় নেতাদের সবাই পালিয়ে গেছেন দেশ ছেড়ে। তারা কোটি কোটি টাকা বানিয়েছে। আমরা যারা তৃণমূলের নেতাকর্মী, তাদের এখন মরণযন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিপদে ফেলে বড় বড় নেতারা সব পালিয়েছেন।’

ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে হামলা ও হত্যার দায়ে অভিযুক্ত যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, নগর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল আজিম রনিসহ আরও অনেকেই ভারতের ত্রিপুরা হয়ে কলকাতায় চলে গেছেন। এর আগে নুরুল আজিম রনি বিমানবন্দর থেকে আটক হওয়ার খবর কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও তিনি কিভাবে ভারত গেলেন কিংবা আদৌ তিনি আটক হয়েছিলেন কিনা— এ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

তবে রাজনৈতিক বিভিন্ন সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর অনেক নেতাকর্মী দৃষ্টির আড়ালে থাকার জন্য আটক হওয়া কিংবা অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার গুজব কৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

অন্যদিকে রামপুর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন ৫ আগস্টের পরপরই আরব আমিরাতের দুবাইয়ে পালিয়ে গেছেন। এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস আরশেদুল আলম বাচ্চু বর্তমানে পালিয়ে রয়েছেন পর্তুগালে।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই সীমান্তপথে ভারতে ঢোকেন তার দুই ব্যক্তিগত সহকারী অমিত কুমার বসু ও রাহুল দাশ। এই দুজনের সঙ্গে নগর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল আজিম রনি কলকাতার একটি হোটেলের একই কক্ষে আছেন বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন।

রাতের মাঝিরঘাটে হঠাৎ নওফেল

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট রাত আটটার দিকে পুরনো একটি প্রাইভেট কারে সদরঘাট এলাকার কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী মাঝিরঘাটের তুলনামূলক সংরক্ষিত ও নির্জন একটি ঘাটে পৌঁছান সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

সেদিন ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নওফেল ভাই যে গাড়িতে করে মাঝিরঘাটে আসেন, সেই গাড়ির এমনই জীর্ণদশা ছিল যে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে একজন মন্ত্রী তাতে চড়ে এসেছেন। হয়তো সবার চোখ ফাঁকি দিতে তিনি এমন কৌশল নিয়েছিলেন।’

সেই গাড়িতে নওফেলের সঙ্গে ছিলেন আরও এক লোক— এমন কথা জানিয়ে ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘তবে আমি ও আমার সঙ্গীদের কেউই তাকে চিনতে পারিনি।’

ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘পাঞ্জাবি পরা নওফেলকে দেখেই চিনে ফেলে আমাদের খানিকটা দূরে থাকা কয়েকজন যুবক। তারা কর্ণফুলী নদীর প্রায় নির্জন ওই ঘাটে আড্ডা দিচ্ছিল। নওফেলকে দেখেই তারা সেলফি তোলার আবদার করে। নওফেলকে ওই সময় খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। তার সঙ্গে থাকা লোকটি হাত উঁচিয়ে যুবকদের মানা করেন। কিন্তু যুবকরা সেলফি তোলার জন্য আবদার করতেই থাকে। তখন নওফেল যুবকদের বলেন, প্লিজ এখন না, আমি খুব রিস্কে আছি, আমার ওপর অনেক চাপ।’

একথা বলার পরপরই নওফেল দ্রুত সামনে এগিয়ে গিয়ে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা একটি ইঞ্জিনচালিত সাম্পানে ওঠে বসেন। সঙ্গে থাকা লোকটিও তাতে ওঠেন। সাম্পানটি খুব দ্রুতই ঘাট ছেড়ে মাঝ নদীর দিকে এগিয়ে যায়।

জানা গেছে, গাড়ি থেকে সাম্পান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পুরো বিষয়টিই সমন্বয় করেন নগরীর ইসলামিয়া কলেজের সাবেক এক ছাত্রনেতা, যিনি আওয়ামী লীগ দলীয় এক সাবেক সাংসদের ভাই। এরপর থেকে নওফেলের দায়িত্ব নেন চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিপবিল্ডার্স কোম্পানির মালিক। শিপবিল্ডার্স কোম্পানির ওই মালিকের বিরুদ্ধে ক্ষমতাচ্যূত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ঘাট দখলসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এর আগে নওফেল কর্ণফুলী নদীর ওপারে তার বাবা মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ এক চেয়ারম্যানের বাসায় অন্তত এক রাত ছিলেন বলেও সূত্রটি দাবি করেছে।

তবে নওফেল সাগরপথে নাকি সীমান্তপথ দিয়ে ভারত গেছেন— এটি এখনও ধোঁয়াশা।

বিএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm