নতুন বছরের শুরুতেই চট্টগ্রামসহ সারাদেশে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। এরমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শৈত্যপ্রবাহ চলেছে। তবে চট্টগ্রামে তাপমাত্রার তুলনায় বেশি শীত অনুভূত হওয়ার অন্যতম কারণ, উত্তরের হিমেল বাতাস। হিমালয় থেকে আসা উত্তরের এই হিমেল বাতাস যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে পথশিশুদের জন্য। শীত নিবারণে কম্বলসহ পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের অভাবে নগরীর পথে পথে দুর্বিষহ রাত পার করছে এসব পথশিশুরা।
চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর, ষোলশহর, ২ নম্বর গেট, জিইসি মোড়, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার, কাজির দেউড়ি ও নিউমার্কেট এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শীতের রাতে ঠাণ্ডার তীব্রতায় কাবু হয়ে জড়োসড়োভাবে শুয়ে আছে পথশিশুরা। ফুটপাত, উড়াল সেতুর নিচে; বাস বা ট্রেন স্টেশন চত্বরসহ বিভিন্ন রাস্তার ধারে শুয়ে শীতে কাঁপছে এসব পথশিশুরা। কেউ কেউ কুড়িয়ে পাওয়া পুরাতন ব্যানার দিয়ে বিছানা বানিয়ে শুয়ে আছে, আবার কেউবা বিছানা ছাড়াই ছেঁড়া-ফাটা পুরাতন কাপড়ে নিজেকে মুড়িয়ে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। তবে মধ্যরাতে বয়ে চলা হিমেল বাতাস যেন পথশিশুদের ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে দিচ্ছে। অতি ঠাণ্ডায় কেউ শুয়ে, কেউবা আবার জড়োসড়ো হয়ে বসে রাত কাটিয়ে দিনের উঞ্চতার অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে অনেকে ঠাণ্ডাজনিত রোগেও আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
এদিকে প্রতি বছর শীতের শুরুতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নগরীর অসহায় পথের বাসিন্দাদের শীতবস্ত্র বিতরণ করতে দেখা যায়। তবে এবার শীতের আগমনের প্রায় দু’মাস অতিবাহিত হলেও এখনো তেমন কোনো কার্যক্রমের দেখা মেলেনি। ফলে পথে পথে পথশিশুদেরকে শীতবস্ত্রের জন্য চাতকের মত তাকিয়ে থাকতে দেখা গেছে।
নিস্তব্ধ রাতের নগরীতে দূর থেকে কোনো গাড়ির শব্দ বা আলো ভেসে আসলে নড়েচড়ে বসছে পথশিশুরা। ধীরগতিতে কোনো প্রাইভেটকার তাদের দিকে এগিয়ে আসলে, শীতবস্ত্রের আশায় সে গাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে তারা। তবে বড়দের ভিড়ে এসব কোমলমতি শিশুরা শারীরিকভাবে পেরে না ওঠায় অনেক সময় এসব গাড়ি থেকে কিছু দিলেও তা নিতে পারে না।
৮ বছর বয়সী সুমি আক্তার ও ১০ বছরের মাহফুজ মিয়া তাদের মায়ের সঙ্গে নগরীর গোলপাহাড় মোড় এলাকার ফুটপাতের বসবাস করে। শীতের তীব্রতায় মাহফুজ পাতলা চাদরে কোনো রকম নিজেকে মুড়িয়ে শুয়ে থাকলেও তার ছোটবোন সুমি রাস্তার ধারে বসে নজর রাখছে চলন্ত গাড়িগুলোর ওপর। তাদের কাছাকাছি কোনো গাড়ি দাঁড়ালেই অন্য পথশিশুদের সঙ্গে দৌড়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শীতবস্ত্রের জন্য।
সুমি আক্তারের মা জানান, প্রত্যেক বছর শীতকালে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে পথের বাসিন্দাদের শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও এবার তেমনটা হয়নি। কিছুদিন আগে কয়েকজন যুবক এসে তাদের পুরাতন কিছু শীতের কাপড় দিয়ে গেলেও তাতে মানছে না শীত। ফলে তীব্র শীতে পথে পথে কষ্টে দিন কাটছে।
পথশিশুদের নিয়ে গড়ে তোলা সংগঠন ‘আলোর ঠিকানা’র প্রতিষ্ঠাতা ঋত্বিক নয়ন বলেন, ‘প্রতি বছর শীত আসলেই কিছু সংগঠন বা ব্যক্তি শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকে। তবে আমার কাছে মনে হয় এটা পর্যাপ্ত না, যতটা হওয়া উচিত তার কেবল এক দ্বিতীয়াংশ হয়; বাকি বড় একটা অংশ বঞ্চিত থেকে যায়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে প্রতি বছর শীত আসলেই শীতবস্ত্র বিতরণে একটা লোক দেখানোর বিষয় কাজ করে। অসহায়দের নিয়ে এই শো-অফের বিষয়টা দুঃখজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত সপ্তাহে সিআরবিতে একটা রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন কম্বল বিতরণ করবে বলে প্রায় ৩ ঘণ্টা ১৫০ জন অসহায় মানুষকে বসিয়ে রাখে, এরমধ্যে শিশুরাও ছিল। পরে তাদের কেন্দ্রীয় নেতা আসার পর ফটোসেশন করে ১০টির মতো কম্বল বিতরণ করে, বাকিগুলো বিতরণের জন্য ৩-৪ জনকে দায়িত্ব দিয়ে অন্যরা চলে যায়। এই সময় ভিড়ের মধ্যে শিশুরা কম্বল নিতে পারেনি।’
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের গভর্নর আমিনুল হক বাবুর কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশে ডিসেম্বরের দিকে শীতের প্রকোপ দেখা দেয়। প্রতি বছর এই সময়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন বা ব্যক্তির অসহায় মানুষের মাঝে লেপ, কম্বল, তোষকসহ বিভিন্ন শীতবস্ত্র বিতরণের চিত্র আমরা দেখি। গত ৫-৬ দিন ধরে শীতের প্রকোপ বেড়েছে। বৃহস্পতিবার হঠাৎ তাপমাত্রা নেমে গেছে ১৪.৯ ডিগ্রিতে, সামনে আর কমতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে ব্যানার গায়ে শুয়ে থাকলেও দেখা যায়, আড়ালে ২-৩টা কম্বল লুকিয়ে রাখে। যাদের কাছে নেই তারা পাচ্ছে না, যাদের কাছে আছে তারাই আবার পাচ্ছে। অনেককে শীতবস্ত্র বিতরণের ছবি ফেসবুকে দিতে দেখলাম। মানুষ মানুষের জন্য, তাই আমরা আশা করবো; সমাজের সামর্থ্যবানরা যে যেভাবে পারেন মানুষের পাশে দাঁড়াবেন।’
জেএন/ডিজে