চট্টগ্রামের দেয়াঙ পাহাড় পুড়ছে লোভের আগুনে, তীরে বিদ্ধ কোরিয়ান ইপিজেড
কর্ণফুলী-আনোয়ারার ‘ফুসফুসে’ বনবিভাগের টহলই নেই
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী-আনোয়ারা উপজেলার কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের (কেইপিজেড) বনাঞ্চলে জ্বলছে আগুন। বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন এলাকার বনভূমিতে লাগা আগুনে ধ্বংস হচ্ছে গাছপালা, উজাড় হচ্ছে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল। এছাড়া জনবল অপ্রতুল হওয়ায় নিয়মিত টহলও দেয় না বন বিভাগ। ফলে বনখেকোদের কারণে চিরহরিৎ এই বনভূমি ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে ছাইয়ের স্তূপে।
তবে দুই উপজেলার ‘ফুসফুস’ খ্যাত এই বনভূমি ধ্বংসের পেছনে স্থানীয়রা দায়ী করছে কেইপিজেডকে। কিছুদিন আগেও তাদের পাহাড় কাটা বন্ধ করেছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
কিন্তু কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা এই আগুন লাগার সঙ্গে সম্পৃক্ত না। তারা শুধুমাত্র বোটানিক্যাল গার্ডেন অংশে পরিষ্কারের কাজ করছে বৃক্ষরোপণের জন্য।
অথচ স্যাটেলাইট দৃশ্যে ও গুগল ম্যাপে দেখা গেছে, একসময় কেইপিজেডের একটি বিরাট অংশ সবুজের চাদরে আচ্ছন্ন ছিল।
এদিকে ফ্রিস্টাইলে পাহাড় কেটে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ স্থাপন করছে একের পর এক কারখানা স্থাপন করছে পাহাড়ে। এতে ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, বণ্যপ্রাণীরাও হারিয়ে ফেলছে আবাসস্থল। ফলে খাবারের খোঁজে প্রায় সময় বন্য হাতির দল হানা দেয় লোকালয়ে। মাঠের ফসল নষ্ট করার পাশাপাশি মানুষের ঘরবাড়িও ভেঙে দেয় হাতির দল। এমনকি তাদের আক্রমণে অনেক মানুষের মৃত্যুও ঘটেছে।
রোববার (২৬ মার্চ) সরেজমিন বড় উঠান এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই চৈত্র মাস এলেই কেইপিজেডের ভেতরে বনভূমির বিভিন্ন স্থানে আগুন দেয় বনখেকোরা, করে পাহাড় নিধনও। এরপর সুযোগ বুঝে বনের মূল্যবান গাছও পাচার করে দেয়।
দেয়াঙ পাহাড় চট্টগ্রামের একটি ঐতিহাসিক পাহাড়। এটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের আনোয়ারা-কর্ণফুলী বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এই অঞ্চলেই আরাকানদের দুর্গ ও দেয়াঙ কারাগার ছিল। এই পাহাড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। এসব বৃক্ষ সংরক্ষণ ও দেখার দায়িত্ব বন বিভাগের। কিন্তু বনের বাগানে বার বার আগুন দিচ্ছে বনখেকোরা। যেখানে অসহায় বন বিভাগ।
বড়উঠান এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কেইপিজেড পরিকল্পিতভাবেই পুড়িয়ে দিচ্ছে বন। এমনটাই দাবি করেছেন তাঁরা। স্যাটেলাইট দৃশ্য ও গুগল ম্যাচে দেখা যায়, এক সময় কেইপিজেড এর একটি বিরাট অংশ সবুজ চাদরে আচ্ছন্ন ছিল। বর্তমানে যা হিংস্র থাবায় গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। অথচ বন উজাড় করার সাথে সম্পৃক্ত নয় কেইপিজেড এমনটাই দাবি করেছেন কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মুশফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘আমরা কেন আগুন লাগাবো। কেউ হয়তো সিগারেট খেয়ে ফেলেছে। আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় বন পরিষ্কার করছি। যেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককের তত্বাবধানে বিভিন্ন গাছগাছালি লাগানো হবে।’
এমন ঘটনায় বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের মধ্যে আমরা অক্সিজেন ও জীববৈচিত্র্যের অন্যতম প্রধান উৎসের এমন ক্ষতি মেনে নিতে পারি না। চট্টগ্রাম তথা কর্ণফুলী-আনোয়ারার মানুষকে অবশ্যই কেইপিজেডের বন রক্ষা করতে হবে। তারচেয়ে বেশি রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষকে।’
চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘বন বিভাগের অধীনে থাকা বন পুড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে অবশ্যই বনখেকোরা জড়িত। এজন্য প্রতিবছর বন আইনে মামলা করা হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
এই বিষয়ে পটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা নুরে আলম হাফিজ বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে কেইপিজেড বনে নিয়মিত টহল করা সম্ভব হয় না। তবে যেখানে গাছ পুড়ে গেছে, সেখানে পুনরায় গাছ লাগানো হবে। অর্থাৎ রিপেয়ারিং করতে হবে। তবে কারা আগুন দেয় খোঁজ খবর নেবো। অসাধু মানুষেরা বনের নিয়ম-কানুন মানতে চায় না।’
চট্টগ্রাম জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘বনে আগুন লাগিয়ে বন সাবাড় করলে বিষয়টি দেখবে বন বিভাগ। পরিবেশ সাধারণত পাহাড় কাটার বিষয়টি দেখে থাকে।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, ‘কেইপিজেডের ভেতর সংরক্ষিত বন থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব বনবিভাগের, তা সঠিক। আমি বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
ডিজে