চট্টগ্রামের তৃণমূলে যেভাবে ছড়ালো ভাষার আন্দোলন

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে চট্টগ্রামে ১৯৪৭ সাল থেকে জনমত তৈরি করার জন্য প্রগতিশীল সাংস্কৃতিককর্মীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সংস্কৃতিককর্মীরা পাকিস্তানের শুরু থেকেই একটি প্রগতিশীল ধারা নির্মাণ করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ‘সীমান্ত’ পত্রিকা দৃঢ় ভূমিকা পালন করে। চট্টগ্রামের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিককর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ব্যাপক জনমত সংগঠিত করার সক্রিয় উদ্যোগ প্রহণ করে। এ ছাড়া ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত আবুল কাসেম সম্পাদিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ পুস্তিকাটি চট্টগ্রামে বেশ প্রভাব ফেলে। তাই দেখা যায় চট্টগ্রামে রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক শুধু বুদ্ধিজীবী মহলে সীমাবদ্ধ ছিল না; জনগণকে সচেতন করার একটি প্রয়াসও এখানে সক্রিয় ছিল।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালনের আহ্বান জানালে চট্টগ্রামেও তা পালিত হয়। প্রতিবাদ সভার প্রচারের জন্য ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে মাইকে প্রচারের সময় মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের ভাড়াটে গুন্ডারা মাহবুব উল আলম চৌধুরী, শহীদ সাবের ও গোপাল বিশ্বাসের ওপর হামলা করে। সেদিন হামলাকারীরা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভাও পণ্ড করে দেয়।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ চট্টগ্রামের কানুনগোপাড়া কলেজ ও স্কুল, ধলঘাট, কেলিশহর, সারোয়াতলী, কাটির হাট, নানুপুর, নোয়াপাড়া, মহারাণী, রাধারাণী প্রভৃতি স্কুলের হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ ছাত্র বাংলাকে অন্যতম কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। ১৪ মার্চও অন্যান্য এলাকার মতো চট্টগ্রামে ছাত্রধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনের ব্যাপকতা দেখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪ মার্চ চট্টগ্রামে এক সপ্তাহের জন্য সভা-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে এক আদেশ জারি করেন।

s alam president – mobile

১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও বাণিজ্যমন্ত্রী যিনি ১৯৪৮ সালে ২৭ ডিসেম্বর করাচিতে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলনে বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রচলনের পক্ষে যুক্তি দেন, তার চট্টগ্রাম কলেজ পরিদর্শনকালে ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে ‘খোলা চিঠি’ প্রচার করে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির সুপারিশমালায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ‘বাংলা’র দাবি উপেক্ষিত হলে সারা পূর্ববাংলায় আন্দোলন গড়ে ওঠে। মূলনীতি কমিটির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকীকে সভাপতি, রেলওয়ে শ্রমিক লীগের মাহবুবুল হক ও ‘সীমান্ত’ পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে কমিটি গঠিত হয়। এভাবে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আন্দরকিল্লাাস্থ তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আহ্বায়ক ছিলেন তখনকার সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী এবং যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন তমদ্দুন মজলিস নেতা ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের অন্যান্য জেলার মতো সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে চট্টগ্রামে হরতাল, মিটিং, মিছিল এবং লালদীঘি মাঠে জনসভার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাতদিন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগানো হয়। পাড়ায় পাড়ায় অবস্থিত ক্লাব ও সংগঠনগুলো হরতাল সফল করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কর্মসূচি অনুযায়ী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচেষ্টার প্রতিবাদে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ণ হরতাল পালিত হয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হত্যাকা্লের খবর ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পৌঁছে। এ সময় জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং রাস্তায় নেমে আসে। বিকালবেলা লালদীঘি ময়দান লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। এ সময় গণপরিষদ সদস্য এ কে খান সেখানে পৌঁছান এবং বক্তৃতা দেবার চেষ্টা করেন। জনতার প্রতিবাদে তিনি বসে পড়তে বাধ্য হন। এ সময় জনতা তাকে ঘিরে ধরলে তুমুল হট্টগোল শুরু হয়। অবশেষে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারলে তিনি গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দিয়ে জনতার রুদ্ররোষ থেকে রক্ষা পান।

Yakub Group

২৪ ফেব্রুয়ারি জেলাব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সব ধরনের যানবাহন, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, অফিস-আদালত এবং কলকারখানা বন্ধ থাকে। ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কলেজ ও স্থানীয় মহিলা বিদ্যালয়সমূহের ছাত্রীরা লরি ও বাসে করে ‘মন্ত্রিসভার পদত্যাগ চাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ প্রভৃতি স্লোগান দিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। চট্টগ্রামের ইতিহাসে মহিলাদের এই ধরনের স্বতন্ত্র বিক্ষোভ প্রদর্শন এটাই প্রথম। এ সময় চট্টগ্রাম তমদ্দুন মজলিস মহিলা বিভাগের পরিচালিকা নূরুন নাহার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি তারা চট্টগ্রাম শহরে হরতাল পালন করে।

চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মূলত ১৯৫১ সালের ১৬-১৯ মার্চ হরিখোলার মাঠে দেশের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনের ভিতর দিয়ে। এর উদ্যোক্তা ‘সাংস্কৃতিক বৈঠক’ এবং ‘প্রান্তিক নব-নাট্য সংঘ।’ এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনের মূল সভাপতি ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। এতে দুই বাংলার বিশিষ্ট লেখক শিল্পীরা যোগদান করেন। এভাবেই চট্টগ্রামে বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দেলনে রূপ পায় এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, সামপ্রদায়িকতা ও বিশ্বশান্তির প্রসঙ্গগুলো গুরুত্ব পায়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!