চট্টগ্রামের ডিসি ফখরুজ্জামানকে সরানো হল অবশেষে, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ

সরানোর দাবিতে মঙ্গলবারও হয়েছে বিক্ষোভ

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানসহ ২৫ জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পৃথক প্রজ্ঞাপনে তাদের প্রত্যাহার করা হয়।

প্রত্যাহারের পাশাপাশি একই আদেশে তাদের নতুন কর্মস্থলে পদায়ন করা হয়েছে। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হবে বলে জানানো হয়।

চট্টগ্রামের ডিসি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে বিভিন্ন মহল।

প্রত্যাহার হওয়া ডিসিদের তালিকায় রয়েছে ঢাকা, সিলেট, রংপুর, কক্সবাজার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, মাগুরা, গাইবান্ধা, নওগাঁ, নাটোর, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, শেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পাবনা, বগুড়া, জয়পুরহাট, চাদঁপুর, খুলনা ও গোপালগঞ্জের ডিসি।

এর আগে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে অবিলম্বে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে তার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবরে চিঠি দেয় চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী সাংবাদিক ঐক্য। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ যেসব জেলা প্রশাসক এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন, ফখরুজ্জামান তাদের অন্যতম।

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) বৈষম্যবিরোধী সাংবাদিক ঐক্যের নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রাম আদালত ভবনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা জেলা প্রশাসক ফখরুজ্জামানকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন। এ সময় বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক মঈনুদ্দিন কাদেরী শওকতসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। পরে তারা চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো চিঠি হস্তান্তর করেন।

বৈষম্যবিরোধী সাংবাদিক ঐক্যের পাঠানো অভিযোগে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যূত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে পাঠানো হয়। ভোটারবিহীন নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে সরাসরি সহায়তা দিয়ে এই কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং আওয়ামীলীগ দলীয় কর্মী হিসেবে জেলা প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের নানা অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন ডিসি ফখরুজ্জামান।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালের জুনে সীতাকুণ্ডে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা ও পরে সংসদ সদস্য হওয়া মুজিবুর রহমানের মালিকানাধীন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৫১ জনের প্রাণহানি ছাড়াও অসংখ্য শ্রমিক আহত হন। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান প্রভাব খাটিয়ে কন্টেইনার ডিপোর হতাহতের ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে মালিককে মামলা থেকে বাঁচিয়ে দেন।

এতে বলা হয়, কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত ওই তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে মালিকপক্ষ ও তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো এই ঘটনার দায় এড়াতে পারে না বলে মতপ্রকাশ করলেও ডিপো মালিকদের বাদ দিয়ে সেখানকার কর্মচারীদের মামলার আসামি করার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন বিশেষজ্ঞরা। কন্টেইনার ডিপোর মালিক আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে জেলা প্রশাসক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন বলেও অভিযোগ আছে।

অভিযোগে বলা হয়, সরকারি আইন অনুযায়ী দেশে ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ রয়েছে। কিন্তু বর্তমান জেলা প্রশাসক চট্টগ্রামের বিভিন্ন তহসিল অফিস ঘাট ইজারার মত ডাক দিয়ে তহসিলদারদের কাছে ইজারা দেয়। একেকটি তহসিল অফিসকে ২ কোটি-৩ কোটি টাকা টার্গেট দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এলএ ফান্ডের নামে সেই টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছেন।

অভিযোগে জানানো হয়, চট্টগ্রামের বর্তমান জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের ডাক নাম বিলাস। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই সময় তিনি শাহ আমানত হলে থাকতেন। নব্বই দশকের শেষ দিকে তিনি ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শাহ আমানত হলের সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে দুই মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ছাত্রলীগের সেই পরিচয় তিনি শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার আগ পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে ব্যবহার করে গেছেন।

অভিযোগে বলা হয়, চট্টগ্রামের ডিসি হওয়ার পর দুর্নীতিতে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। ডিসি পার্কসহ বিভিন্ন প্রকল্পে তার ব্যাপক দুর্নীতির পাশাপাশি বন্দরের জায়গা দখলেরও একটি অভিযোগ রয়েছে। ডিসি পার্কের নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন। চাঁদা না দিলে মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ভয়ভীতিও দেখান অনেক ব্যবসায়ীকে। এ সম্পর্কিত খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবের কারণে সেসব ধামাচাপা পড়ে যায়।

তোপের মুখে একের পর এক

এর আগে গত শনিবার (১৭ আগস্ট) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ক এক বৈঠক শেষে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার তোপের মুখে পড়েন জেলা প্রশাসক ফখরুজ্জামান। এ সময় তারা ডিসি ফখরুজ্জামানকে উদ্দেশ্য করে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ‘হাসিনা সরকারের দালাল’ ‘গণহত্যার সহযোগী’— এরকম বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকেন। বিক্ষোভকারীরা অবিলম্বে ডিসির অপসারণ ও শাস্তি দাবি করেন। ওই সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক সেখানে অবস্থান করছিলেন।

এর আগে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ চট্টগ্রাম জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে অবিলম্বে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে বরখাস্ত করার দাবি জানান।

এক যুক্ত বিবৃতিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে উল্লেখ করে গত ৪ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দুই দিন আগে শান্তি কমিটি গঠনের মাধ্যমে দেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে কঠোর হস্তে দমন করার নির্দেশদাতা হিসেবে তাকে অবিলম্বে চাকরি থেকে বরখাস্ত দাবি জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm