চট্টগ্রামের চা বাগান তাকিয়ে আছে আকাশে, বৃষ্টির অভাবে সবুজ পাতা বিবর্ণ
অনাবৃষ্টির কারণে চট্টগ্রামে মারা যাচ্ছে চা গাছ। চট্টগ্রামের ২১টি চা বাগানের প্রায় গাছ বৃষ্টির অভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। সবুজ বাগানগুলো হয়ে গেছে বিবর্ণ। গাছে নতুন কুঁড়ি নেই। খন্ড খন্ড বাগান জ্বলে যাচ্ছে রোদের খরতাপে। উৎপাদনের চেয়ে বাগানের গাছ বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছে চা বাগান সংশ্লিষ্টরা।
চা বাগান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দুই বছর ধরে এপ্রিলের আগে বৃষ্টি দেখা নেই চট্টগ্রামে। যদিও এর আগে ফেব্রুয়ারি বা মার্চেই বৃষ্টি হতো। এ বছর এখনও বৃষ্টি না হওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চা বাগানগুলোতে। প্রকৃতির এমন আচরণকে বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাব বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে শ্রমিকদের কাজও বন্ধ হয়ে আছে।
চট্টগ্রামে চা বাগানগুলোর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মোহাম্মদ নগর, আধারমানিক, নাছেহা, দাঁতমারা, পঞ্চবটি, মা জান, এলাহি নূর, কৈয়াছড়া, কর্ণফুলী, উদালিয়া, নেপচুন, রামগড়, বারোমাসিয়া, রাঙ্গাপানি, নিউ দাঁতমারা, কোদালা ও বেলগাঁও চা বাগান।
সরেজমিনে কয়েকটি চা বাগান ঘুরে দেখা গেছে, গাছ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। সবুজ বাগানগুলোর পাতা বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাগানের নতুন চারাগাছ (ইয়ং টি) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চা বাগানে খন্ড খন্ড অংশ জ্বলে গেছে। যা দেখতে আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়ার মতো। কোনো কোনো বাগানে শ্রমিকরা কলসি, বালতি ইত্যাদি দিয়ে পানির সেচ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় এক দশমিক ৬৯ মিলিমিটার। ২০২১ সালে এই তিন মাসে বৃষ্টির ছিঁটেফোটাও দেখা যায়নি। ২০২২ সালে এসেও চট্টগ্রামে বৃষ্টির দেখা নেই। ফলে নিরুপায় বাগানের মালিক-শ্রমিকরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন বৃষ্টির আশায়।
সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এমন পরিস্থিতি আর কিছুদিন অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবার চায়ের উৎপাদনে ধস নামবে। বাগানগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ শ্রীমঙ্গলে গত তিন মাসে ২০২১ সালের মার্চ মাসে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৩১ মিলিমিটার। চলতি বছরের গত তিন মাসেও প্রায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়র পর্যবেক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এ দুই মাসে শ্রীমঙ্গলে ২৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।মার্চসহ তিন মাসে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। আগাম বৃষ্টির কারণে ওই অঞ্চলে চায়ের বাম্পার উৎপানের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।’
চা বাগানের মালিকরা জানান, গত বছরও নভেম্বর মাস থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা মেলেনি চট্টগ্রামে। এবার ঠিক একইভাবে নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত বৃষ্টি পড়েনি এ অঞ্চলে। দিনে প্রচণ্ড রোদে তাপমাত্রা ৩৭-৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকছে। এ অবস্থায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় মাটি শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। বাগানগুলোতে অনেকটা হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে।
কর্ণফুলী চা বাগানের ডিজিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টি না হওয়ার কারণে উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। শ্রমিকদের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। গাছে নতুন কুঁড়ি নেই। খন্ড খন্ড বাগান জ্বলে যাচ্ছে খরায়।’
তিনি বলেন, ‘গত ৬ মাসের তীব্র খরায় চট্টগ্রামের বাগানগুলোর প্রায় ২৫ ভাগ চারাগাছ রোদের তাপে মরে গেছে। আগামী ৭-৮ দিনের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাত হলে হয়তো জুন-জুলাইয়ে স্বল্প পরিমাণে উৎপাদনে যেতে পারবে বাগানগুলো। অথচ শ্রীমঙ্গলে এবার পর্যাপ্ত পরিমাণ আগাম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে ওখানকার বাগানগুলোতে দ্রুত কুঁড়ি ও পাতা গজিয়েছে। তারা আমাদের আগেই উৎপাদন শুরু করতে পেরেছে। এ অবস্থায় এবার চা উৎপাদনে চট্টগ্রাম অঞ্চল অনেক পিছিয়ে থাকবে বলে মনে হচ্ছে।’
নেপচুন বাগানের জিএম কাজী ইরফান উল্লাহ বলেন, ‘অনাবৃষ্টির কারণে শুধু উৎপাদন হ্রাস পাবে তা নয়, চায়ের গুণগত মানও ক্ষুণ্ন হবে। রোগবালাই বাড়বে।’
রাঙ্গাপানি চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক উৎপল বিশ্বাস বলেন, ‘খরার তীব্রতা যান্ত্রিক সেচের মাধ্যমে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এখন উৎপাদনের চেয়ে বাগানের গাছগুলো বাঁচানোর লড়াই করছি আমরা।’
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মেঘনা তঞ্চঙ্গ্যা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে বৃষ্টির দেখা মিলতে পারে চট্টগ্রামে। কিন্তু এই অঞ্চলে কালবৈশাখীর কোনো পূর্বাভাস নেই। তবে সপ্তাহের মাঝামাঝি বৃষ্টি হলেও আবার তাপমাত্রা বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যান্য সব অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে। বরিশালে শিলাবৃষ্টিও হলো। কিন্তু চট্টগ্রামে বৃষ্টির দেখা নেই। আমাদের ধারণা অনুযায়ী বৃষ্টি হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।’
এমএফও/সিপি