চট্টগ্রামে দেশের সবচেয়ে বড় সাইলো বা খাদ্য গুদামে গম চুরির ঘটনায় তদন্ত চলছে গত দুই সপ্তাহ ধরে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম সাইলোর অধীক্ষক মো. আসাদুজ্জামানসহ চার প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সাইলোতে কী পরিমাণ গম আছে— সেটা পরিমাপ করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে সাইলো কর্তৃপক্ষের ঘোষণা দেওয়া ৭৩ হাজার ২৯০ মেট্রিক টন গম স্টকে আছে কিনা, নাকি এর চেয়ে বেশি আছে তাও মেপে দেখা হচ্ছে। চট্টগ্রামের সাইলোতে গম চুরির ঘটনা জানানো হয়েছিল সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া থেকে।
দেশে খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে গম আমদানি করছে বাংলাদেশ। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে জিটুজি প্যাকেজ-৪ এবং প্যাকেজ-৫ এ আসা ১ লাখ মেট্রিকটন গম খালাসের সময় বড় আকারের গম চুরির ঘটনা ঘটে। শুরুতে রাশিয়া থেকেই গম পরিমাণে কম দেওয়া হয়েছে— এমন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে নিশ্চুপ থাকে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশেই এই গম চুরি হয়েছে— রাশিয়ান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এই তথ্য নিশ্চিত করে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। এরপরই খাদ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদন্তের উদ্যোগ নিল।
এরই মধ্যে সপ্তাহখানেক আগে চট্টগ্রাম সাইলোর অধীক্ষক মো. আসাদুজ্জামানসহ চার প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্যরা হলেন রক্ষণ প্রকৌশলী শাহরিয়ার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন চৌধুরী, সহকারী রক্ষণ প্রকৌশলী রাজেশ দাশগুপ্ত ও মুশফিকুজ্জামান।
জানা গেছে, রাশিয়া থেকে পাঠানো গমের মোট দুটি প্যাকেজের এক চালানে ৫০০ টন এবং অপর চালানে প্রায় ৭০০ টন গম চুরি হয়ে যায়। গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনে এই গম চুরির ব্ষিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর চট্টগ্রামের সাইলোতে গম চুরির বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই ব্যস্ত ছিল কর্তৃপক্ষ। যার দিকে উঠেছে সন্দেহের তীর, সাইলোর সেই অধীক্ষক আসাদুজ্জামানও বহাল তবিয়তে রয়ে যান।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সাইলো বা খাদ্য গুদামে থেকে গম চুরির ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশের পরই সরকারি-বেসরকারি সব দপ্তরেই আলোচিত হয়। নড়েচড়ে বসে খাদ্য অধিদপ্তরসহ মন্ত্রণালয়। এরপরই গম চুরি তদন্ত করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংগ্রহ ও সরবরাহ অনু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খাজা আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
এছাড়া তদন্ত তদারকির জন্য মন্ত্রণালয়ের অধিশাখা প্রশাসন-২-এর উপসচিব একেএম মামুনুর রশিদ ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম সাইলো পরিদর্শন করেছেন।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলাম খান বলেন, চট্টগ্রাম সাইলোর স্টক ভেরিফাই বা ওজন পরিমাপ করার জন্য বলা হয়েছে। কী পরিমাণ গমের ঘাটতি রয়েছে বা অনিয়ম হয়েছে এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে মন্ত্রণালয় থেকেই।
অনিয়ম তদন্ত কমিটির সভাপতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংগ্রহ ও সরবরাহ অনু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খাজা আব্দুল হান্নান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের সাইলো পরিদর্শন করেছি। স্টক ভেরিফাই করার কাজ চলছে। একটু সময় লাগবে।’
এর আগে রাশিয়া থেকে জানানো হয়েছিল চট্টগ্রামের সাইলোতেই ঘটছে গম চুরির ঘটনা। বিদেশি একটি সরকারের কাছ থেকে এমন ‘অপমানজনক’ তথ্য জানানোর পর এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে টনক নড়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। ইতিমধ্যে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটিও। যা এখনও চলমান রয়েছে।
গম সরবরাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন জানান, প্রতিনিয়ত গম চুরি হয় চট্টগ্রাম সাইলো থেকে। কিন্তু কোন প্রতিকার পাচ্ছিলাম না। এবার স্টক ভেরিফাই করা হচ্ছে। ওজন ভেরিফাইয়ে ধরা পড়ছে। কারণ সাইলো কর্তৃপক্ষ বর্তমানে ৭৩ হাজার ২৯০ মেট্রিক টন গম স্টকে রয়েছে বলে জানিয়েছে। কিন্তু পরিমাণে বেশি থাকলে এবং কম থাকলে দুই দিকেই ফাঁসবে সাইলো কর্তৃপক্ষ তথা অধীক্ষক।
অভিযোগ রয়েছে, মাদার ভ্যাসেল থেকে নিউমেটিক আনলোডার দিয়ে জাহাজের হ্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম খালাস করে গুদামজাত করার সময় সাইলো কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লাইটার জাহাজে অতিরিক্ত বোঝাই করে চুরি করা হয় গম। যা নারায়ণগঞ্জ নেওয়ার পথে চাঁদপুরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আবার নারায়ণগঞ্জের সাইলোতে কম না পড়ে মতো ওজনে সমান রাখা হয়। পথে কৌশলে পাচার হয়ে যায়। এতে লাইটারে অতিরিক্ত বোঝাই করা গম মাদার ভ্যাসেলে আমদানি করা গমের ওজনে কম পড়ে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশ থেকে আমদানি করা গম চট্টগ্রামের সাইলোতে এলেই ৫০০ থেকে ১ হাজার মেট্রিক টন কমে যায়। এই গম সাইলোতেই চুরি হয় এভাবে। এতে ব্যবসায়ীদের চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সাইলোতে গম বোঝাই মাদার জাহাজ ভিড়লে সেটি থেকে অর্ধেক গম আনলোড করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় দিনের পর দিন। এতে বন্দরের চার্জ ও জাহাজের অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হয় ব্যবসায়ীদের। জাহাজের গম খালাসের জন্য শ্রমিক, বন্দরের স্টাফ, স্টিভিডোর ও সাইলো অপারেটদের ২৪ ঘন্টায় তিন শিফটে দৈনিক ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। অথচ তারা সরকারি বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন। এসব নানা অনিয়মের কারণে এখন রাশিয়া থেকেই অভিযোগ আসে চট্টগ্রামে গম চুরির।
সিপি