চট্টগ্রামের গণটিকায় গণহয়রানি, টোকেন পেল কাউন্সিলরের লোকজনই

ইউনিয়ন পর্যায়ের অবস্থা আরও বেহাল

শনিবার সকাল ১০টা। চট্টগ্রাম নগরীর ৭ নম্বর হামজারবাগ ওয়ার্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে কয়েক শ’ মানুষের দীর্ঘ লাইন। সকলেই গণটিকা কর্মসূচির সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছেন টিকা নিতে। কিন্তু এখানে জাতীয় পরিচয়পত্র কোনো কাজেই আসেনি। কাউন্সিলর মোবারক আলীর এই ওয়ার্ডে কাজে এসেছে বিশেষ একটি টোকেন। যাদের হাতে এই বিশেষ টোকেন ছিল কেবল তাদের ভাগ্যেই জুটেছে টিকা। টোকেনবিহীন ব্যক্তিদের এই কেন্দ্র থেকে চলে যেতে হ্যান্ডমাইককে ঘোষণা দিতে দেখা গেছে কয়েকজনকে।

এমন অনিয়ম শুধু চট্টগ্রাম নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডেই নয়, চট্টগ্রামে করোনার গণটিকাদান কর্মসূচিতে নানাভাবেই হয়রানির শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। টিকা কেন্দ্রের একেকটিতে পাতা হয়েছে একেক নিয়মের ফাঁদ। শুরুতে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে কেন্দ্রে যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয় টিকা গ্রহণ করতে। পরে এই কর্মসূচির আওতা সীমিত হয়ে যাওয়ার বিপাকে পড়ে যায় টিকা গ্রহীতারা।

হাজার হাজার মানুষ ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও টোকেন না পেয়ে ঘরে ফিরেছেন হতাশ হয়ে। কেন্দ্রপ্রতি ৩০০ টিকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেক টিকা কেন্দ্রে হাজির ছিল হাজারের বেশি মানুষ। শনিবার (৭ আগস্ট) গণটিকা কার্যক্রম শুরুর প্রথমের দৃশ্য ছিল এমন।

দিনশেষে অভিযোগ উঠে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ঠজন ছাড়া খুব কম মানুষের ভাগেই জুটেছে টিকা।
চট্টগ্রামের গণটিকায় গণহয়রানি, টোকেন পেল কাউন্সিলরের লোকজনই 1
শনিবার সকাল ৭টার দিকে বায়েজিদ থানার ড. মাজাহার উচ্চ বিদ্যালয়ে টিকা দিতে যান সামিনা আক্তার (৩৮)। টিকার লাইনে তার আগে ছিল ১৪ জন। দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ওই কেন্দ্রের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় শুধুমাত্র করোনার সম্মুখ সারির যোদ্ধা ও সরকারি চাকরিজীবীরাই টিকা পাবেন। বাকিরা যেন ফিরে যান। অথচ গণটিকা কর্মসূচির কোথাও এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

নগরীর পাঠানটুলি সিটি করপোরেশন বয়েজ স্কুলে টিকা দিতে যাওয়া শারমিন নামে একজন জানিয়েছেন সুরক্ষা অ্যাপের রেজিষ্ট্রেশন কার্ড নিয়ে টিকা দিতে যান তিনি। এসময় তার কার্ড দেখে তাকে বলা হয় এসএমএস এলে নির্দিষ্ট কেন্দ্রেই টিকা নিতে হবে তাকে।

মেয়র গলি আরবান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখা গেল আরেক চিত্র। সেখানে টিকা দেওয়া হয়েছে শুধুই পঞ্চাশোর্ধ নাগরিকদের।

নগরীর সবকেন্দ্রেই কমবেশি এমন দৃশ্য ছিল শনিবারের গণটিকা কার্যক্রমে। প্রচন্ড ভিড় মাড়িয়েও নানা নিয়মের ফাঁদে পড়ে টিকা না পেয়েই ফিরতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। এক্ষেত্রে স্থানীয় কাউন্সিলরসহ জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়স্বজন ও রাজনৈতিক কর্মীদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে টিকা দেওয়া হয়েছে- এমনটাই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

কোথাও কোথাও কাউন্সিলরদের দেওয়া বিশেষ টোকেনে মিলেছে টিকা। অনেক কেন্দ্রে টিকা নিতে আগ্রহীদের ভিড় সামলানো বিপরীতে পছন্দের মানুষকে টিকা পাওয়ার সুযোগ করে দিতে দেখা গেছে ভলেন্টিয়ারদের।

সকাল ১০টার দিকে ৭ নম্বর হামজারবাগ ওয়ার্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, টিকা প্রার্থীদের দীর্ঘ লাইন। কিন্তু সবার হাতেই বিশেষ টোকেন। হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে টোকেনবিহীন টিকা প্রার্থীদের চলে যেতে বলা হচ্ছে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোবারক আলী।

‘টোকেন’ দেয়ার বিষয়ে চসিকের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোবারক আলী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কথা ছিল দিনে ৯০০ করে মোট ৩৬০০ টিকা দেয়া হবে। শেষ মুহুর্তে যখন এটা পরিবর্তন হয়ে সব মিলিয়ে ৯০০ জনকে টিকা দেয়ার কথা হলো তখন আমাদের বলা হয়েছে কেন্দ্র প্রতি ৩০০ জন সিলেক্ট করতে।’

এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে মানুষজন এলে টিকা কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠিন হবে। এসব ভেবে আমরা কেন্দ্র প্রতি ২০০ মানুষকে আগে থেকে সিরিয়াল দিয়েছি। এটা একটা সিরিয়াল, টোকেন নয়। আরবান ভলন্টিয়ারদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে বয়োবৃদ্ধদের এটি দেয়া হয়েছে। যাতে তাদের টিকা নিতে অসুবিধা না হয়। আর বাকি ১০০ আমরা কেন্দ্রে আসা মানুষজনদের মধ্য থেকে দেব এমনটাই পরিকল্পনা ছিল।’
চট্টগ্রামের গণটিকায় গণহয়রানি, টোকেন পেল কাউন্সিলরের লোকজনই 2
ইউনিয়ন পর্যায়ে গণটিকা কর্মসূচির দৃশ্য আরও বেহাল। ইউনিয়ন পর্যায়ে মানুষকে ডাকা হয়েছিল মাইকিং করে৷ ফলে কমবেশি সবখানেই ছিল উপছে পরা ভিড়। কেন্দ্রগুলোর টিকা দেওয়ার সক্ষমতার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ মানুষ ছিল প্রায় সকল কেন্দ্রে। ফলে দিনভর ভোগান্তি শেষে টিকা না পেয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছে প্রচুর মানুষকে। দিনশেষে তাই গণটিকা কর্মসূচি পরিণত হয়েছিল অনেকটা ‘গণভোগান্তি’ কর্মসূচিতে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘স্থানীয়দের সুবিধার কথা বিবেচনা করে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। টোকেনের বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কোনো নির্দেশনা নেই। সাধারণ মানুষের টিকা না পাওয়ার বিষয়টি খুব দুঃখজনক ও অমানবিক।’

শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম জানান, ৭ আগস্ট ২৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পঞ্চাশের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী, নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী টিকা পাবেন। জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে গেলই উল্লেখিত ক্যাটাগরির নাগরিকদের টিকা দেওয়া হবে।

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!