চট্টগ্রামের এক অভিজাত ক্লাবের নির্বাচনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুই মামলায় অভিযুক্ত এক আসামির ভোটে দাঁড়ানোর ঘটনায় সদস্যদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
আগামী বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামের অভিজাত ক্লাব হিসেবে পরিচিত চিটাগং সিনিয়র্স ক্লাবের বার্ষিক নির্বাচন। এতে সহ-সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মো. রেজাউল করিম। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর সাড়ে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা ও দেড় কোটি টাকা টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রেজাউল করিমসহ তিন চিকিৎসক ও দুই ঠিকাদারসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ডা. রেজাউল আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। চিটাগং সিনিয়র্স ক্লাবের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘটনায় সাধারণ সদস্যদের অনেকে ক্ষোভ জানিয়েছেন।
দুর্নীতির কলকাঠি নড়েছিল যেভাবে
প্রচলিত বাজারদরে আসবাবপত্রের প্রকৃত মূল্য ৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অথচ সেই আসবাবপত্রের দাম দেখানো হয় ২০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। দুই ঠিকাদারের সঙ্গে মিলে এভাবে ১৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মো. রেজাউল করিমসহ তিনজন ডাক্তার। এর মধ্যে দেড় কোটি টাকা মেরেই দেওয়া হয়।
এমনই অবিশ্বাস্য দুর্নীতির ঘটনা ঘটে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ঘিরে। অথচ দেখা গেছে, ওই কলেজে আসবাবপত্র কিংবা যন্ত্রপাতি— কোনোটিরই ছিল না বাড়তি চাহিদা। এমনকি বিভাগীয় প্রধানদের কাছে চিঠি পাঠিয়েও কোনো চাহিদা পাওয়া যায়নি। শেষমেশ দুর্নীতিবাজ চক্রটি নিজেরাই তৈরি করে কৃত্রিম চাহিদা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে সে অনুযায়ী আসবাবপত্র ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য নিজেরাই আহ্বান করে দরপত্র। সেই দরপত্রে কাজও পায় নিজেদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই। পরে শুধু ব্যবহারের অনুপযোগী নন-ব্রান্ডের আসবাবপত্র সরবরাহের নামেই সাড়ে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করা হয়। এর বাইরে আত্মসাতই করে ফেলা হয় দেড় কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, দুর্নীতির পথ সুগম করতে তৈরি করা হয় দুটি ভুয়া জিও বা সরকারি আদেশও।
এমন ঘটনায় প্রায় ৫ বছরের দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর সাড়ে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা ও দেড় কোটি টাকা টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল করিমসহ তিন চিকিৎসক ও দুই ঠিকাদারসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুর্নীতির এসব ঘটনায় অন্তত তিনজন ডাক্তার সরাসরি জড়িত ছিলেন। এরা হলেন— কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মো. রেজাউল করিম, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক (বর্তমানে বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজে কর্মরত) ডা. মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ, হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক (বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক) ডা. আবুল বরকত মুহাম্মদ আদনান। যে দুই ঠিকাদারের যোগসাজশে তারা এই অপকর্ম চালান, ওই দুজন হলেন— ঢাকার মগবাজার দিলু রোডের মেসার্স এস এল ট্রেডার্সের মালিক মিঞা সাদুল্লাহ বিন হাসান এবং নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের মালিক আফসানা ইসলাম কাকলী।
২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর আসবাবপত্র সরবরাহের নামে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা ও দেড় কোটি টাকা টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল করিমসহ তিন চিকিৎসক ও দুই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে ওই মামলা দুটি দায়ের করেন।
এর মধ্যে এক মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আসবাবপত্রের চাহিদা না থাকার পরও প্রতারণার মাধ্যমে নিম্নমানের আসবাবপত্র বাজারদরের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কিনে সরবরাহ করেন। ভ্যাট ও আয়কর বাবদ ১ কোটি ৫৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬০৯ টাকা আত্মসাত করেন তারা এবং আরও ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬১২ টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও প্রয়োজন না থাকার পরও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ থেকে ৭৬ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৫ টাকার আসবাবপত্র কিনে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছেন আসামিরা।
এই মামলায় আসামি করা হয় চট্টগ্রামের জামালখান রোডের সানমার ম্যাগনোলিয়া ভবনের বাসিন্দা (বর্তমান ঠিকানা) ও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মো. রেজাউল করিম, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক (বর্তমানে বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজে কর্মরত) ডা. মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ, হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক (বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক) ও লোহাগাড়ার উত্তর কলাউজানের বাসিন্দা ডা. আবুল বরকত মুহাম্মদ আদনান, কক্সবাজার জেলা মার্কেটিং অফিসার শাহজাহান আলী এবং নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের মালিক আফসানা ইসলাম কাকলীকে।
অন্যদিকে অপর মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুইটি ভুয়া জিও সৃষ্টি করে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও নিম্নমানের আসবাবপত্র উচ্চ মূল্যে সরবরাহ করে ১৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৮৭ টাকা সরকারকে আর্থিকভাবে ক্ষতিসাধন ও আত্মসাতের প্রচেষ্টা করার অভিযোগ আনা হয়।
দ্বিতীয় এই মামলার আসামিরা হলেন— কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল করিম, সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ও বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ, সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবুল বরকত মুহাম্মদ আদনান, জেলা মার্কেটিং অফিসার শাহজাহান আলী ও ঢাকার মগবাজার দিলু রোডের মেসার্স এস এল ট্রেডার্সের মালিক ফরিদপুরের বোয়ালমারীর বাসিন্দা মিঞা সাদুল্লাহ বিন হাসান।
২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ঘটা আত্মসাতের ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪১/৫১১/১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।