দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো পদ্মা সেতুর সুফল পাবে চট্টগ্রামের মানুষ। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার উৎপাদিত পণ্য, বিভিন্ন কাঁচামাল সরাসরি আসবে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের উৎপাদিত পণ্যও যাবে ২১ জেলায়। এতে করে দুই অঞ্চলে ব্যবসার প্রসার ঘটবে, অর্থনীতির চাকাও গতিশীল হবে। এতো দিন সেতু না থাকার ফলে বৃহৎ এই সম্ভাবনা আলোর দেখা পায়নি।
দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ জেলায় উল্লেখযোগ্য হারে কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ধান, পাট, গম, পিঁয়াজ, আলো, মিষ্টি আলু, টমেটো, আদা, তরমুজ ও খেজুরের গুড় অন্যতম। এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা আছে চট্টগ্রামে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ না থাকায় এই পণ্যগুলো চট্টগ্রামে আনা যেত না। দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ উৎপাদিত পণ্য পরিবহন হতো ফেরি দিয়ে। ফেরি দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার করতে অনেক সময় ৩ থেকে ৫ দিন লাগে। এছাড়া নদীতে ভাটার সময় ফেরি আটকে যায়। আটকে গেলে আরো বেশি সময় লাগে। এসব কারণে কৃষিপণ্য নষ্ট হয়ে যায়। এখন সেই পদ্মা নদী পার হতে সময় লাগবে ৫ থেকে ৭ মিনিট।
পণ্যগুলো দ্রুত পচনশীল হওয়ায় অনেক সময় নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে হতো দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের। এখন পদ্মাসেতু দিয়ে অনায়াসে আনা যাবে এসব পণ্য। কৃষকরা পাবে নায্য দাম। ক্ষেত থেকে কৃষিপণ্য তোলার পর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই চট্টগ্রামে পৌঁছে যাবে। পরিবহন খরচ কমার ফলে তুলনামূলক কম দামেও পণ্য পাবে চট্টগ্রামের মানুষ।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় চট্টগ্রামের পণ্য সরাসরি যেতে পারতো না। ওই এলাকার পণ্য চট্টগ্রামে আসতো না। ওই অঞ্চলের কৃষি পণ্যের চাহিদা আছে চট্টগ্রামে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার ফলে ব্যবসা গড়ে উঠেনি। এখন ৭ থেকে ১৩ ঘন্টায় বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলায় পণ্য আনা নেয়া করা যাবে। এতে দুই অঞ্চলের অর্থনীতির গতি বাড়াবে। একইভাবে চট্টগ্রামবন্দরের পণ্যও দ্রুত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় পৌঁছে যাবে। এছাড়া সারা দেশের জেলাগুলোর মধ্যে পণ্য পরিবহণে গতিশীলতা বাড়বে, সময় কমবে।
চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের কাঁচা সবজির আড়তদার মেসার্স নিউ একতা বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী আবু তৈয়ব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা কৃষিপণ্য তেমন আনা যেত না। এখন ২৪ ঘন্টার মধ্যে আনা যাবে পণ্য। টাটকা ফল পাবে চট্টগ্রামের মানুষ। আগের মতো পচে যাওয়ার ভয় থাকবে না। পরিবহন খরচ যেহেতু কমে আসবে, পণ্যের দামও কম হবে।’
বরিশাল উজিরপুরের বাসিন্দা মাহবুবের সাথে কথা হয় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের। মাহবুব বলেন, ‘অনেক খামারি দুধ বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দিতেন। আমাদের এলাকায় এগুলো নিত্য দিনের ঘটনা। কিন্তু এখন দুধ বা কৃষি পণ্যে খুব সহজ সারা দেশে পরিবহন করা যাবে। বরিশালের আমড়া সারা দেশে জনপ্রিয়। এই আমড়া সারাদেশে পরিবহন করতে আর কোন বাধা নেই।’
তিনি বলেন, ‘দুই মাস আগে আমার অসুস্থ মাকে নিয়ে পদ্মা পার হতে ফেরির জন্য ১২ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখন সেই পদ্মা পার হওয়া যাবে ৫ মিনিটে। ঢাকা থেকে বাড়িতে যেতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। যা দক্ষিণবঙ্গের মানুষ স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। সেটা বাস্তবায়ন হয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আলাউদ্দিন মজুমদার বলেন, ‘অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের পচনশীল পণ্য চট্টগ্রামে আসতো না। এখন যা অনায়াসে আসতে পারবে। পরিবহন খরচ, শ্রম ও সময় কমবে। অনেকটা সুলভ মূল্যে পণ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া তিনটি বন্দরের সাথে স্থলপথে চট্টগ্রামের যোগাযোগ হবে। যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
এদিকে পদ্মা সেতুর ওপারে সংযোগ সড়ক থেকে ভাঙ্গা উপজেলা থেকে তিনদিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে। এর একটি বরিশাল, একটি খুলনা অংশে, আরেকটি রাজবাড়ী, যশোর, বেনাপোলে। এ তিনটি সড়ক যুক্ত হবে মংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোল স্থল বন্দরের সঙ্গে। ফলে তিন বন্দর দিয়েই আমদানি পণ্য দ্রুত চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলগুলোয় প্রবেশ করতে পারবে। এতে রফতানি পণ্যের লিড টাইম (ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরির পর রফতানি করতে যে সময় লাগে) কমে যাবে। ফলে দ্রুত ব্যবসার রিটার্ন বা মুনাফা পাওয়া যাবে। এতে অর্থের চলাচল বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে বহুমুখী খাত। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।
সিপি