চকরিয়ার ফুলের গ্রাম সরগরম ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে

তাজা ফুলের বাজারে চোখ রাঙাচ্ছে প্লাস্টিকের ফুল

একপাশে সবুজ ধান ও সবজির মাঠ, অন্য পাশে গাছগাছালিতে ভরপুর বনের পাহাড়। গ্রামবাংলার এ রূপকে আরো বেশি সুরভিত করে তুলেছে গোলাপ ও গ্ল্যাডিওলাসের বাগান।

কক্সবাজারের চকরিয়ার বরইতলী ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে যাওয়া কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশ জুড়েই বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়েছে এই ফুলের চাষ। গ্রামীণ জনপদটিতে প্রায় সারা বছর গোলাপের চাষ হলেও মুলত শীতকালেই আসল মৌসুম। এসময় গ্ল্যাডিওলাসসহ গোলাপ ফুল পরিপূর্ণ যৌবন লাভ করে। ফুলের বিকিকিনিতে হাসি ফোটে চাষীদের মুখে।

গোলাপ ফুলকে বলা হয় ফুলের রাণী। জাতভেদে গোলাপ ফুলের রং, আকৃতি ও গন্ধ ভিন্ন হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে নজর কাড়ে গ্ল্যাডিওলাসও। বিয়ে-গায়ে হলুদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও সারা বছরই চাহিদা রয়েছে এই ফুলের।

পুরো দেশের মধ্যে সাভার, যশোর, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলায় ফুল চাষ হলেও গত একদশক ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চকরিয়ায় উৎপাদিত ফুল বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও রাজধানীর চাহিদাও অনেকটাই পূরণ করে যাচ্ছে।

কাপড় ও প্লাস্টিকের তৈরি কৃত্রিম ফুলের কারণে আসল ফুলের বাজার চাহিদা খানিকটা কমলেও কমেনি কদর। এবার সেই কদর আরও বেড়েছে পরপর দুটি দিবসকে ঘিরে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দুটি দিবসে ফুল সরবরাহ করে অর্থ আয়ের লক্ষ্যে খেটে চলেছেন ফুলচাষীরা।

চকরিয়ার ফুলের গ্রাম সরগরম ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে 1

এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি দিবসে অন্তত অর্ধ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট নিয়ে চকরিয়ার ফুলচাষীরা পরিশ্রম করে যাচ্ছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকেই চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফুল সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে এখানকার চাষীরা।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক লাগোয়া বরইতলী ইউনিয়নজুড়েই রয়েছে একের পর এক ফুলের বাগান। কক্সবাজারমুখী পর্যটকদেরও নজর কাড়ে এ নজরকাড়া এই ফুলের বাগান। বরইতলী ছাড়াও সাহারবিল এলাকাসহ পুরো উপজেলায় শতাধিক ব্যক্তির ফুলের বাগান রয়েছে। অন্তত ১০০ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে করা হয় ফুলের এই চাষ।

সরেজমিনে বরইতলী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নারী-পুরুষদের কেউ বাগান পরিচর্যা করছিলেন। কেউ তুলছিলেন ফুল। আবার কেউ বান্ডেল করে নিয়ে যাচ্ছিলেন খামারবাড়িতে। সেখান থেকে রিক্সা ও ভ্যান গাড়িতে করে স্টেশনে নিয়ে পিকআপ বোঝাই করে বিক্রির জন্য চট্টগ্রামসহ নানা স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

ফুলচাষীরা জানান, সুর্যের তাপ বাড়ার আগেই গ্ল্যাডিওলাস তুলে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার আড়তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভোর থেকে সারাদিনই তোলা হয় গোলাপ ফুল।

স্থানীয় ফুলচাষী আহসান উল্লাহ প্রায় দুই একর জমিতে গোলাপ ও এক একর জমিতে গ্ল্যাডিওলাস এবং আরেক চাষী বোরহান উদ্দিন ৩৩ শতক জমিতে গ্ল্যাডিওলাস ও ১ একর ৪০ শতক জমিতে গোলাপের চাষ করেছেন। দুজনের ফুল বাগানেই ১০-১৫জন করে শ্রমিক রয়েছে। শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী। কম মজুরিতে নিরলস পরিশ্রম করতে পারায় ফুলবাগানের কাজে নারী শ্রমিকদের চাহিদাও বেশি।

এই দুই চাষীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি কানি জমি ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বর্গা নিয়ে তারা চাষ করছেন। এর মধ্যে কলম দেওয়া গোলাপ একবার রোপণ করলে ৪-৫ বছর পর্যন্ত ফুল পাওয়া যায়। গ্ল্যাডিওলাস চাষ করে তিন মাস মেয়াদের মধ্যেই ফুল বিক্রি শেষ করতে হয়। তাদের মতে, ৪০ শতক জমিতে ফুল চাষ করতে ১ লাখ টাকা খরচ হয়। চাহিদা ও ন্যায্যমূল্য পাওয়া গেলে মুনাফাও ভালো হয়।

তবে কাপড় ও প্লাস্টিকের চায়না ফুলে বাজার এসে তাদের কষ্টে উৎপাদিত ফুলের বাজারে ভাগ বসাচ্ছে। তারা বলেন, যশোর থেকে আমরা প্রথমে গ্ল্যাডিওলাসের বীজ সংগ্রহ করেছিলাম। পরে নিজেদের চাষ থেকেই বীজ সংগ্রহ করি পরবর্তী মৌসুমের জন্য। একইভাবে নিজেদের করা বাগানের গোলাপ গাছ থেকে কলম করে চারা সংগ্রহ করে ফুল চাষ করে থাকি।

আহসান ও বোরহান আরও বলেন, একটি গ্ল্যাডিওলাস উৎপাদনে খরচ হয় ৪-৫ টাকা আর বিক্রি হয় ৭ টাকায়। গোলাপ উৎপাদনে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ পয়সা ফুলপ্রতি খরচ হয়। বিক্রি হয় ৩ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত। তবে বাজার চাহিদা কমে গেলে খরচের টাকাও ওঠে না ফুল বিক্রি করে।

বরইতলী ফুল বাগান সমিতির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে আট মাস বন্ধ ছিল ফুলের চাষ। ওই সময়টাতে আমরা বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। অনেকে ফুল চাষ বন্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে ফুল চাষ কমে গেছে। এখন মোটামুটি পরিস্থিতি ভালো রয়েছে। আশা করছি কোন রকমে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবো।’

তিনি বলেন, ‘চকরিয়ায় শতাধিক ব্যক্তি অন্তত কয়েকশত একর জমিতে ফুল চাষ করেছে এবার। দুই বছর আগে তিন থেকে সাড়ে ৩০০ একর জমিতে ফুল চাষ হলেও কৃত্রিম ফুলের কারণে প্রতি বছর চাষের পরিমাণ কমে গেছে। লকডাউনের কারণে ফুল চাষ কমে যাওয়ায় আট মাস কোনো ফুল বিক্রি হয়নি। তবে বিভিন্ন দিবসে চাহিদা বাড়ায় ফুল বিক্রি বেড়েছে কিছুটা। এ সময় প্রতি চাষী ২ থেকে ৩ লাখ টাকা করে মুনাফা অর্জন করে।’

মঈনুল ইসলাম আরও বলেন, শুধুমাত্র শতাধিক চাষি নয়, চকরিয়ার ফুল বাগানে শ্রমজীবির কাজ করে ৩ থেকে ৪ হাজার শ্রমিক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক শ্রমিক প্রথমে অন্যের জমিতে কাজ করলেও এখন নিজেরাও জমি বর্গা নিয়ে বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেছে।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এসএম নাসির হোসেন বলেন, ‘চকরিয়ায় সরকারি হিসেবে মোট ৮৩ হেক্টর বা ২০৫ একর জমিতে গোলাপ ও ৫২ হেক্টর বা ১২৮ একর জমিতে গ্ল্যাডিওলাস চাষ হয়েছে। সরকারিভাবে ফুল চাষীদের সাহায্য করার কোনো সুযোগ নেই। তাই তাদের সেরকম সহযোগিতা দিতে পারছি না। শুধুমাত্র ফুল চাষ নিয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকি আমরা।’

তিনি আরও বলেন, উপজেলা প্রশাসন এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে বরইতলীর ফুলবাগানকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে ফুলচাষীদের সাথে আলোচনাও হয়েছে। তাছাড়া ফুলচাষীদের আবারও ফুল চাষে ফিরিয়ে আনার জন্য পানি সমস্যাসহ নানা ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!