প্রায় পাঁচ মাস ঝুলিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে শাহজাহান চৌধুরীকে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে শুধু চট্টগ্রাম-১৫ আসনটিতেই প্রার্থী ঘোষণা বাকি রেখেছিল দলটি। তবে এই ঘোষণা যতটা জাঁকজমকপূর্ণ ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল এর পরের নাটকীয়তা। কয়েক ঘণ্টার মাথায় দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো এই প্রার্থীকে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্র ও স্থানীয় পর্যায়ে দ্বিধা, আস্থার সংকট এবং স্পষ্ট বিভক্তির চিত্র ফুটে উঠেছে।

প্রার্থী ঘোষণা, এরপরই পদচ্যুতি
শুক্রবার (১৩ জুন) সকালে সাতকানিয়ার কেরানীহাটের একটি রেস্টুরেন্টে আয়োজিত ‘দায়িত্বশীল সমাবেশে’ প্রার্থিতার ঘোষণা দেন দলের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। একইদিন বিকেলে নগরীর দেওয়ানবাজারে মহানগর জামায়াতের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘দায়িত্বশীল সমাবেশে’ শাহজাহান চৌধুরীকে সরিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মো. নজরুল ইসলামকে। তিনি নায়েবে আমির ছিলেন এর আগে। মিয়া গোলাম পরওয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দেন।

দলের ভেতর এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই দেখছেন ‘সমঝোতার ফল’ হিসেবে, যেখানে প্রার্থিতা দিয়ে নেতৃত্ব থেকে কৌশলে সরিয়ে রাখা হয়েছে শাহজাহান চৌধুরীকে।

রাতে যদিও চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মোহাম্মদ উল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাতকানিয়া শাহজাহান চৌধুরীকে আজ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওপেন হার্ট সার্জারি আছে, তিনি অসুস্থও। এছাড়া তাকে এখন থেকে সাতকানিয়ায় বেশি সময় দিতে হবে। সবমিলিয়ে তার ওপর লোড পড়ে যাবে— এই কারণে তার বদলে নায়েব আমির নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয়েছে।’
পাঁচ মাস ধরে মনোনয়ন আদায়ের লড়াই
চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২৩টি আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। তবে চট্টগ্রাম-১৫ আসনটিকে সে সময় ফাঁকা রাখা হয়, যদিও শাহজাহান চৌধুরী শুরু থেকেই দাবি করে আসছিলেন যে এই আসনে তিনিই চূড়ান্ত প্রার্থী।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি জুন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে—বিশেষ করে চট্টগ্রামের প্যারেড মাঠে অনুষ্ঠিত তাফসিরুল কুরআন মাহফিলে, বিভিন্ন গণজমায়েত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি নিজেকে ‘চূড়ান্ত প্রার্থী’ হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ওই একটি আসনে এখনও প্রার্থিতা চূড়ান্ত হয়নি।
এই নিয়ে দলের ভেতরে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। সূত্র বলছে, শাহজাহান চৌধুরী বিভিন্ন সময় ‘যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করবো’ বলে কেন্দ্রকে চাপ দিয়ে আসছিলেন। অবশেষে তার চাপের কাছে নতি স্বীকার করে প্রার্থিতা দেওয়া হলেও, একইসঙ্গে মহানগর নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দল জানিয়ে দেয়—পুরো আস্থাটা আর নেই।
‘…তবে দল বললে আসন ছেড়ে দিতে হবে’
সাতকানিয়ার ‘দায়িত্বশীল সমাবেশে’ জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আমরা ৩০০ আসনে আমাদের প্রার্থী প্রস্তুত করেছি। কিছু না ছাড়লে তো প্রেম হবে না। প্রেম কি একতরফা হয়? দুই তরফা লাগে। তাকে কিছু আমাকে দিতে হবে, সেও আমাকে কিছু দিবে। আর যে আসনগুলো এখন ঘোষণা করা হচ্ছে, পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় জামায়াত আমির বলে দিয়েছেন, আপনাদের যে আসন দেওয়া হলো তার অর্থ এটা না, এ আসন আপনার। মনে রাখবেন এটা জামায়াতের আসন। জামায়াত যখন বলবে তখন ছেড়ে দিতে রাজি। প্রয়োজনে আমির সাহেবও তার আসন ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন বৈঠকে।’
এক নেতাকে ঘিরেই দ্বিধাবিভক্ত দল
গত কয়েক মাসে চট্টগ্রাম মহানগর ও সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার জামায়াতে শাহজাহান চৌধুরীকে ঘিরে তৈরি হয় দুটি সুস্পষ্ট ধারা। সূত্র জানায়, একদিকে তার ঘনিষ্ঠ অনুসারী গ্রুপ এবং অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী সংগঠনের মূলধারা।
গত ৩ মার্চ সাতকানিয়া উপজেলার মধ্যম কাঞ্চনা এলাকায় ডাকাতসন্দেহে নেজাম উদ্দিন (৪৬) এবং আবু ছালেক (৩৮) নামের দুই জামায়াত ক্যাডারকে ক্ষুব্ধ জনতা পিটিয়ে মেরে ফেলে। দুজনই ছিলেন শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী। এই ঘটনায় চট্টগ্রাম মহানগর ও সাতকানিয়া-লোহাগাড়া জামায়াতে দুটি ধারার অস্তিত্ব প্রকাশ্য হয়ে ওঠে।
এই দ্বিধা প্রকট হয়ে ওঠে মার্চ মাসে, যখন সাতকানিয়ার মধ্যম কাঞ্চনা এলাকায় ডাকাত সন্দেহে শাহজাহানপন্থী দুই জামায়াত কর্মী—নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেক—জনতার হাতে নিহত হন। এই ঘটনার পর শাহজাহানের অনুসারীদের নিয়ে এলাকাজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে।
অঘটনে বারবার আলোচনায় মহানগর আমির
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় শুরু হয় একের পর এক চাঁদাবাজি, হামলা ও অপহরণের ঘটনা। এসব ঘটনার সঙ্গে জামায়াতের নাম জড়ানোয় দলের ভাবমূর্তি তলানিতে ঠেকে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর থেকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় মাটি-বালির বেপরোয়া ব্যবসায় জড়িতদের নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের গোয়েন্দা রিপোর্টে শাহজাহান চৌধুরীর ঘনিষ্ঠদের নাম ওঠে আসে। সূত্র জানিয়েছে, ওই তালিকার বিষয়টি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও পরে অবহিত হন।
গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর লোহাগাড়ার পদুয়া এলাকার ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম অভিযোগ আনেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার দুই প্রতিষ্ঠানে ৩৬ লাখ টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পরে ক্যাশবক্সে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় মামলা করার প্রায় তিনদিন পর ওই ব্যবসায়ীকে দেখা করতে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আদিলের মাধ্যমে ফোন করেন চট্টগ্রাম নগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরীর ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) আরমান উদ্দিন। দোকান খুলে ব্যবসা করা এবং লুট করা মালামাল উদ্ধারে ১৫ লাখ টাকার চাঁদা দাবি করেন আরমান। চুক্তি অনুযায়ী ৮ লাখ টাকা না দেওয়ায় তাকে অপহরণ করে বেধড়ক মারধর করা হয়। সবশেষ তাকে মামলায় জড়িয়ে খাটানো হয় জেল।
পরে অবশ্য শাহজাহান চৌধুরীর পিএস আরমানের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন ডেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।
চলতি বছরের ৬ মে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াত কার্যালয়ে আয়োজিত এক সভায় শাহজাহান চৌধুরী দাবি করেন, ‘জামেয়া মাদ্রাসার রুমে রুমে সেনাবাহিনীর অভিযানে অস্ত্র পাওয়া গেছে।’ একই সঙ্গে তিনি চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ দুই সুফি দরবার ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার শরীফ ও পটিয়ার আমিরভাণ্ডার দরবারে অস্ত্র মজুদ থাকার ইঙ্গিত দেন। তার এই বক্তব্যের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তুমুলভাবে সমালোচিত হন শাহজাহান চৌধুরী। তবে ওই বক্তব্য দেওয়ার ২৪ ঘন্টা পর তার লাইভে এসে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করেন তিনি। তবে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা তার এই বক্তব্য ভালোভাবে নেননি।
গত ২৮ মে চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে নারীসহ অনেক কর্মীর ওপর হামলার ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনায় হামলাকারীদের পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বিশেষ করে লাথি মেরে দেশজুড়ে তীব্র বিতর্কের জন্ম দেওয়া জামায়াত নেতা সিবগাতুল্লাহ ওরফে আকাশ চৌধুরী শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী হওয়ায় দলের অভ্যন্তরে তিনিও পড়েন সমালোচনার মুখে। পরে অভিযুক্ত আকাশ চৌধুরীকে জামায়াত ইসলামী থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে অভিযোগে দলজুড়ে অস্বস্তি
গত ৫ মে সকালে চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে সুন্নি জনতার ব্যানারে পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশের পক্ষ নিয়ে স্থানীয় পরিচয়ে একদল যুবক হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায় এবং ধাওয়া দেয়। সুন্নিদের দাবি, তারা সবাই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। এ ঘটনায়ও শাহজাহান চৌধুরী সমালোচিত হন।
এর আগে গত বছরের ১০ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে জামায়াত-সমর্থিত চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির শিল্পীদের ইসলামী সংগীত পরিবেশনের ঘটনায় দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ার পর মহানগর আমির হিসেবে শাহজাহান চৌধুরী প্রথম আলোচনায় আসেন। ওই ঘটনায় দুই শিল্পীকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ।
সর্বশেষ গত বুধবার (১১ জুন) সাতকানিয়ায় জহির উদ্দিন মিন্টু নামে এক বালি ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মারধর ও ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারীদের নাম ওঠে আসে। জায়গা ভরাটের কথা বলে ডেকে নিয়ে ৫২ বছর বয়সী ওই ব্যবসায়ীকে পার্শ্ববর্তী আউল্লা ঘোনা পাহাড়ে অপহরণকারীদের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিপণের স্বর্ণ নিতে সমতলে আসার পর ভোরে যৌথবাহিনীর অভিযানের মুখে দুর্বৃত্তরা তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার (১২ জুন) ভোরে কাঞ্চনা স্লুইচ গেইট এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।
প্রার্থিতা পেলেও আস্থা পড়েছে সংকটে
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শাহজাহান চৌধুরীকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রার্থী হিসেবে মানতে বাধ্য হলেও সম্পূর্ণ আস্থায় রাখতে পারছে না। ফলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। দলের ভেতরে যেভাবে তাকে ঘিরে দ্বিধা তৈরি হয়েছে, তাতে নির্বাচনী প্রচারণার সময় নানা প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।’
সিপি