অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা বা রাজনীতিতে এশীয়দের অবদান অনেকদিন প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসছিল। বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসনামলে এটি বিশ্বাস করা হতো। কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় অবিভক্ত ভারতবর্ষের নিজস্ব স্বতন্ত্রতা ছিল উল্লেখযোগ্য। যদিও এই চিন্তাভাবনা দুটি ভিন্ন ধর্ম মতে স্থাপিত হয়েছিল। প্রথমটি হিন্দু ধর্ম এবং অপরটি বৌদ্ধ ধর্ম মতে। বিশেষত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই সময়েই ব্রিটিশদের এই চিন্তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন হয়। তখন ভারতীয় গবেষকগণ প্রতিবাদ করেন এবং এটি প্রমাণ করেন যে, রাজনীতির ক্ষেত্রে এশীয়দের অবদান অবিস্মরণীয়।
এঁদের একজন ভিক্ষু পারেখ। তিনি প্রাচীন ভারতবর্ষের দুটি ধারা, যা রাজনৈতিক দিকগুলো উক্ত হয়েছিল, সেই ধারাগুলো উল্লেখ করেন। এই দুটি ধারা বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মপ্রধান। হিন্দু ধর্ম মতে আবার এই ধারাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়— ধর্মশাস্ত্র এবং দণ্ডশাস্ত্র।
বৌদ্ধ ধর্ম মতে, এই ধারাটিকে ভিক্ষু পারেখ তুলনা করেন ‘Rebel Child’ হিসেবে। যা ধর্মশাস্ত্রের সাধারণ চিন্তা চেতনাগুলো অনুসরণ করে।
সিদ্ধার্থ গৌতমের সময়কালে রাজারা রাজধর্ম পালনের জন্য নানা দিকনির্দেশনা গ্রহণ করতেন স্বয়ং বুদ্ধের নিকট থেকে। রাজারা জ্ঞানীর কাছে রাজধর্ম বিষয়ে জানতে চাইবে, এটি খুবই স্বাভাবিক।
একজন সন্ন্যাসী যিনি নিজের সুখ-শান্তির কথা না ভেবে জগতের সকল প্রাণীর সুখের কথা ভেবেছেন, তাঁর রাজ্য পরিচালনার জ্ঞানও অতি সূক্ষ্ম হবে—এটিই সত্য। তাই রাজারা বুদ্ধের নিকট যেতেন রাজধর্ম জানতে।

বুদ্ধের রাজ্য পরিচালনার নীতিতে গণতন্ত্রের চর্চা সুপ্রতিষ্ঠিত। যা হিন্দুশাস্ত্রের রাজনৈতিক চিন্তাধারা থেকে আলাদা। কারণ আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখি ধর্মশাস্ত্রে ‘মনু’ ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত রাজা। মনে করা হয় যে, ঈশ্বর রাজ্য পরিচালনার জন্য মনুকে পাঠিয়েছিলেন সমাজের শান্তিরক্ষায়। এই যুক্তির বাস্তব প্রমাণ মনের মধ্যে একাধিক প্রশ্ন রেখে যায়।
অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্ম মতে, প্রজারা একজন রাজা নির্বাচন করবে এবং সে রাজাই রাজ্য পরিচালনার মাধ্যমে সমাজের শান্তি বজায় রাখবে। এই যুক্তি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, কারণ এই যুক্তি সন্দেহাতীত। প্রজাদের শান্তি কামনায় নিয়োজিত প্রাণ যে রাজা, তিনিই প্রজাদের কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। এভাবে রাজ্য পরিচালনা করলে রাজ্যে সুখ-শান্তি বজায় থাকে। প্রজাদের সাধারণ চাহিদা পূরণ হয় এবং প্রজারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
গণতন্ত্র ব্যবস্থা ব্যাহত হলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা দেয়। বুদ্ধের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় প্রত্যেক প্রজা ক্ষমতার সমান অংশীদার। একটি রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রজাদের সুখ, শান্তি ও স্বচ্ছলতা বজায় রাখতে পারাই রাজার কর্তব্য।
বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, সমাজে সমাজে যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, তার অন্যতম কারণ হলো গণতন্ত্রের চর্চা না করা। প্রজা বা নাগরিকরাই যে সমাজের, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস, তা ভুলে যাওয়া। স্বৈরাচারী মনোভাব এ ধরনের ধারণার জন্ম দেয় যে, যিনি দেশ পরিচালনা করবেন তিনিই প্রধান। কিন্তু এই মনোভাব থেকে সরে এসে সিদ্ধার্থ গৌতমের অমোঘ বাণী অনুসরণ করলেই এই অজ্ঞানতা কেটে যায় এবং প্রজাই যে ক্ষমতার প্রধান, সকল ক্ষমতার সমান অংশীদার, তা স্পষ্ট হয়।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মূল কারণ হলো, বুদ্ধের দেখানো পথ থেকে সরে এসে এমন এক ব্যবস্থার সমর্থন করা, যা সমাজের শান্তি বিনষ্ট করে এবং সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।