‘গৃহবিবাদ’ তুঙ্গে—ক্ষোভে পুড়ছে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ

অছাত্র, বিবাহিত, মামলার আসামি, নিজেদের ও বিতর্কিতদের নিয়ে কমিটি করার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিনের এই অভিযোগ তোয়াক্কা না করে আবারও নিজেদের পছন্দের মানুষ নিয়ে মঙ্গলবার (১০ মে) মোহরা ও জামালখান ওয়ার্ডের কমিটি ঘোষণা করেন নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর। নতুন কমিটি গঠন নিয়ে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

মঙ্গলবার রাতে দুই ওয়ার্ডে কমিটি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা আসে চার পাল্টা কমিটির। ইমু-দস্তগীর কমিটির সহ-সভাপতি আবুল খালেক ও যুগ্ম সম্পাদক মো. মইনুর রহমান এই পাল্টা কমিটির অনুমোদন দেন। তারা দু’জন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তারা সদরঘাট ও চান্দগাঁও থানা কমিটি এবং পূর্ব ষোলশহর ও চান্দগাঁও ওয়ার্ড কমিটি ঘোষণা করে নগর ছাত্রলীগের প্যাডে।

এদিকে জামালখান ও মোহরা ওয়ার্ড ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীরা। অভিযোগ উঠে, এই দুই কমিটিতে আ জ ম নাছিরের কোনো অনুসারীর নাম নেই। এটাকে মনগড়া ও স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবেও দেখছেন তারা।

পাল্টা কমিটি দেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যুগ্ম সম্পাদক মো. মইনুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, নগর ছাত্রলীগ সভাপতি ইমু ও সাধারণ সম্পাদক দস্তগীর নগর কমিটির সদস্যদের মতামত না নিয়ে তাদের ইচ্ছামতো কমিটি ঘোষণা করছেন। এতে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা এককভাবে নিজেদের মনগড়া কমিটি দিয়ে রাজনীতির সুশৃঙ্খল ধারা ভেঙে দিচ্ছেন। যার কারণে আমরা প্রকৃত ছাত্র ও ত্যাগীদের নিয়ে কমিটি গঠন করেছি।’

তার দাবি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে নির্দেশনা ছিল নতুন কমিটি গঠন না করার। তারা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশনা অমান্য করেছে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রামের সাংগঠনিক দায়িত্ব পাওয়া প্রদীপ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘তারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কমিটি নিয়ে কথা বলেছে কিনা আমার জানা নেই। আমি গ্রামের বাড়িতে আসছি। নতুন কমিটি সম্পর্কে আমি জানি না।’

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ নগর ছাত্রলীগ কমিটি ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে ছাত্রলীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বলছে, বর্তমান কমিটির অধিকাংশ নেতা বিবাহিত ও অছাত্র। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি করার পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তিন কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে। তবুও বহাল তবিয়তে আছে নগর ছাত্রলীগ। এতে রাজনৈতিক জট প্রকট হয়ে উঠেছে। বাড়ছে রাজনৈতিক কোন্দল। দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকে বিরুদ্ধে। তবে সবকিছু জেনেও রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ রয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি।

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ দুটি বলয়ে বিভক্ত। এরমধ্যে একটি বলয় নগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর, অন্যটি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের। ইমু-দস্তগীর দুজনেই মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। তাদের দেওয়া কমিটির বিরুদ্ধে খোদ মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা পাল্টা কমিটি ঘোষণা করে।

এর আগে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাট থানা ও উত্তর হালিশহর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিটি ঘোষণা করে নগর ছাত্রলীগ। এরপরই নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত এ কমিটিকে ‘প্যাকেজ’ কমিটি আখ্যায়িত করে বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করেন পদবঞ্চিত নেতারা। এর তিনদিন পর ২ জানুয়ারি সেই ওয়ার্ডে পাল্টা কমিটি ঘোষণা করেন নগর ছাত্রলীগেরই বিভিন্ন পদে থাকা ১১ নেতা। নগর ছাত্রলীগের প্যাডে ইমরান খান আরজীকে সভাপতি ও হামিদুল হাসান সিফাতকে সাধারণ সম্পাদক করে আগামী এক বছরের জন্য ২৫ সদস্যের পাল্টা এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর আগে নগর ছাত্রলীগ ঘোষিত হালিশহর থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে তৃতীয় শ্রেণি পাশ, এমনকি ফার্নিচার মিস্ত্রিকেও থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে ইমু-দস্তগীরের বিরুদ্ধে।

মহসীন কলেজ ছাত্রলীগকর্মী এনাম হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বলেই পাল্টা কমিটিগুলো দেওয়া হয়। কমিটি-পাল্টা কমিটি মানেই কোনো না কোনো সংঘাতের আশঙ্কা। যার ফলে তৃণমূল ছাত্রলীগের রাজনৈতিক চর্চা নষ্ট হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কেন এসব দেখেও নগর কমিটি ভেঙে দেয় না সেটা আমাদের চিন্তার বিষয়। ২০১৩ সালের পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যেখানে ৩ বার নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়েছে, সেখানে নগর ছাত্রলীগ এতবছর কেন?’

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ২৯১ জনের কমিটিতে বিবাহিত নেতার সংখ্যা ৭০ জনের উপরে। যারা সংগঠনের চেয়ে নিজের সংসার এবং কর্মজীবনে সময় দিচ্ছেন বেশি। এর বাইরেও অনেক আগে ছাত্রত্বের পাঠ চুকিয়ে ফেলেছেন অনেকে। ফলে নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে নিজেদের আখের গোছানোর কাজেই ব্যস্ত নগর ছাত্রলীগ নেতারা।

২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর ইমরান আহমেদ ইমুকে সভাপতি ও নূরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ২৪ জনের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সিলেকশনের মাধ্যমে গঠিত ওই কমিটির মেয়াদ ছিল এক বছর। এরমধ্যে সাধারণ সম্পাদকের পদ খালি হওয়ায় সেখানে স্থান করে নেন জাকারিয়া দস্তগীর। এরপর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে নগর ছাত্রলীগ। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের মধ্যদিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণার কথা।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!