আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ‘বিশিষ্ট নাগরিকের’ ব্যানারে বিবৃতি দিয়ে বেড়ানো অপরূপ চৌধুরীই এখন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) পরিচালনা পর্ষদের নতুন চেয়ারম্যান। ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে (ইউসিবি) নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতেই অপরূপ চৌধুরীকে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে বসিয়েছেন।
মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) ঢাকার গুলশানে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে অপরূপ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের বিবৃতির প্রতিবাদ জানিয়ে গণমাধ্যমে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) পরিচালনা পর্ষদের নতুন চেয়ারম্যান অপরূপ চৌধুরী। এভাবে ‘বিশিষ্ট নাগরিকের’ ব্যানারে বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে দেওয়া বিবৃতিতে তার নাম দেখা যেতো।
চেয়ারম্যান বদল ১৩ দিনের মাথায়
অপরূপ চৌধুরী ২০১৭ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। এর আগে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ইউসিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান রুখমিলা জামান পদত্যাগ করেন। তিনি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের স্ত্রী। তাদের দুজনের নামে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্পদ রয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, শুধু যুক্তরাজ্যেই সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ১ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে, যা ইউসিবির আমানতকারীদের টাকা লুট করে পরিশোধ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর গত ১৪ আগস্ট নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যাংকের ওয়েবসাইটে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের বোন রোকসানা জামান চৌধুরীর নাম প্রকাশ করা হয়। এর ১৩ দিনের মাথায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে অপরূপ চৌধুরী নির্বাচিত করা হয়।
এদিকে মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) রাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইউসিবির পর্ষদ ভেঙে দেয়। একই সঙ্গে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে। ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার শরীফ জহির ও তানভির খানকে পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরা হলেন—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ইউসুফ আলী ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ওবায়দুর রহমান।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের পক্ষে সাফাই
২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার কার্যালয়ের প্রেস ব্রিফিং বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে ৮১ জন ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ একটি বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ, পুলিশ হত্যা, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা, ভাঙচুরসহ সব ধরনের সহিংসতাকে ‘রাজনৈতিক প্রতিবাদ’-এর অন্তর্ভুক্ত করায় এই বিবৃতিটি অপরাধীদের আরও নৃশংস হতে উৎসাহিত করতে পারে।
বিবৃতিদাতারা সুস্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারকের বাসভবনে হামলাকারী সব দুষ্কৃতকারীকে বিএনপির কর্মী হিসেবে শনাক্ত করা হলেও জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের সেই বিবৃতিতে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রায় ৩৫ জন সাংবাদিককে আহত করার ঘৃণ্য ঘটনা জাতিকে উদ্বিগ্ন করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে ইতিমধ্যে এ ঘটনায় জড়িত মুখোশধারী ও অন্য আক্রমণকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে তাদের সুস্পষ্ট যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী হিসেবে আওয়ামী লীগ সমর্থক ‘বিশিষ্ট নাগরিক’দের মধ্যে সাবেক সচিব অপরূপ চৌধুরীর নাম ছিল।
সাফাই গেয়েছিলেন ভোটারবিহীন নির্বাচনের পক্ষে
২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আহ্বান জানানা দেশের ৯১ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এতে ৪৯ নম্বর ক্রমিকে ছিল সাবেক সচিব অপরূপ চৌধুরীর নাম।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়, সংবিধান অনুযায়ী ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা সচেষ্ট রয়েছেন। কিন্তু একটি মহল নির্বাচনকে বানচাল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। চূড়ান্তভাবে অংশগ্রহণ করা প্রার্থীদের সংখ্যা ১ হাজার ৮৯৬ জন। প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে সারাদেশে সৃষ্টি হয়েছে অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উৎসমুখর পরিবেশ। সব বিভ্রান্তি ও বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে দেশের মানুষ এখন মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্ধুব্ধ হয়ে উন্নয়নের ধারা অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিন্তু একটি চিহ্নিত কুচক্রি মহল দেশের জনগণ ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। রাজনীতির আড়ালে সক্রিয় উন্নয়ন ও প্রগতিবিরোধী এই অপশক্তির বিরুদ্ধে দেশের সচেতন নাগরিকদের সোচ্চার হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
১০ নম্বরে ছিল অপরূপ চৌধুরীর নাম
২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল বাতিলে ১৪১ জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা দেওয়া বিবৃতির তীব্র প্রতিবাদ জানান ৩৮৫ জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও বিশিষ্টজন। এই ৩৮৫ জনের মধ্যে ১০ নম্বরে ছিল অপরূপ চৌধুরীর নাম।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাস, প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারকদের বাসভবনে হামলা, কর্তব্যরত পুলিশকে নির্মমভাবে হত্যা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হাসপাতালসহ অন্যান্য স্থাপনায় হামলা করা হয়েছে। এই একই মহল নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য ২০১৪ সালেও একইভাবে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, সড়কপথে বৃক্ষ কর্তন, নির্বাচন অফিসগুলোয় অগ্নিসংযোগ, ভোটারদের নির্মমভাবে প্রহার-এমনকি কর্তব্যরত প্রিজাইডিং অফিসারকে ব্যালট বাক্সের ওপরে কুপিয়ে হত্যা করার মতো নৃশংস ও বর্বরোচিত ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এখনো সেই একই মহল নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর তাকে একতরফা নির্বাচন তপশিল বলে আখ্যায়িত করে তা বাতিলের দাবি করছে।
সিপি