ক্রসফায়ারে স্কুলছাত্রের জীবননাশ— ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ নাকি নামের ভুল?

‘আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে চুপ করে আছি’— বাবার আর্তি

‘অস্ত্র উদ্ধার’ অভিযানের সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মামলার ২ নম্বর আসামি জয়নাল নিহত। ঘটনার পর একটি দেশীয় এলজি, কিরিচ ও চারটি কার্তুজের খোসা উদ্ধার করা হলেও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এসআই গোলাম মোহাম্মদ নাসিম হোসেন ও কনস্টেবল মাসুদ রানা নামে দুজন ‘আহত’ হন।

পুলিশের চিরাচরিত নাটকীয় ভাষ্যে উল্লেখ করা হয়েছিল এভাবেই। মামলা তদন্তের ভার যে পুলিশ কর্মকর্তার হাতে, তিনিও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানান। আদালতও সেই অনুযায়ী যথারীতি অব্যাহতি দেন। কিন্তু অল্পদিন পরেই ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে— যখন আসল আসামি জয়নাল হঠাৎ আইনজীবীর মাধ্যমে ওই মামলায় হাজিরা দেন আদালতে। প্রশ্ন ওঠে তখনই— তাহলে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেল কোন্ জয়নাল?

অনুসন্ধানে নেমে দেখা গেল, আসল জয়নালের বদলে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানা পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক নিরাপরাধ জয়নাল। নামে মিল থাকলেও দুজনেরই পিতা ও ঠিকানা আলাদা। এদের একজনের সঙ্গে অন্যজনের দূরতম সম্পর্কও নেই। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত জয়নাল নোয়াখালীর মাইজদীর নুরুল ইসলামের ছেলে। অন্যদিকে মামলার আসল আসামি জয়নাল চট্টগ্রাম নগরীর রৌফাবাদ পাহাড়িকা আবাসিক এলাকার আবদুল জলিলের ছেলে।

এদিকে আবার জানা যাচ্ছে, নামের মামুলি ভুলে নয়, জেনেশুনেই ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছে দশম শ্রেণির ছাত্র জয়নালকে। এর নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে স্থানীয় এক সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতার আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। তাদের দ্বন্দ্বের বলি হয়েছে নিরীহ ছাত্রটি।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩ নভেম্বর বায়েজিদ থানার রৌফাবাদ পাহাড়িকা আবাসিক এলাকার শাহ আলম নামে এক ব্যক্তির বাসায় ঢুকে মারধর, হত্যাচেষ্টা ও চুরির ঘটনায় সাতজনের নামে মামলা হয়। এতে স্থানীয় বখাটে মো. জয়নালকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। নানা নাটকীয় ঘটনার পর চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে বিচারাধীন এই মামলার কার্যক্রম বর্তমানে রয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বায়েজিদ পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণ হারানো জয়নাল প্রকৃতপক্ষে এই মামলার আসামিই নন। বায়েজিদের ভোকেশনাল অ্যান্ড টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তিনি। ভাগ্যের পরিহাস, ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাত ১টায় নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের মাঠেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নিরীহ জয়নাল। বায়েজিদ পুলিশ তখন বরাবরের মতোই গণমাধ্যমকে বলেছিল— নিহত জয়নাল ‘বেশ কয়েকটি মামলার আসামি’ এবং ‘দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী’।

এদিকে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে মামলার প্রকৃত আসামি আসল জয়নাল আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে থাকায় পুলিশ এখন কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত নিরীহ তরুণ জয়নালকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে— এমন অভিযোগ তার পরিবারের।

জানা গেছে, নিরীহ জয়নাল নিহত হওয়ার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দীপংকর চন্দ্র রায় আসামির তালিকা থেকে আসল জয়নালের নামটি বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশিট দেন গত বছরের ১৫ অক্টোবর। সেই অভিযোগপত্রে তিনি লিখেছেন— ‘এজাহারের ২ নম্বর আসামি মো. জয়নাল, পিতা আবদুল জলিল পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তার নিহত হওয়ার সব বিষয় ও কাগজপত্র মামলার কেস ডকেটে (সিডিতে) নোট রাখি। একাধিকবার চিঠি দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসি) সংগ্রহ করেছি।’

এই চার্জশিট আদালতে দাখিল করার পর আদালত ওই মামলার দুই নম্বর আসামি ‘মৃত’ জয়নালকে অব্যাহতি দেন। কিন্তু এরপরই আদালতে হাজিরা দিতে আসেন আসল আসামি জয়নাল। এভাবে এরই মধ্যে মোট তিন দফা শুনানিতে হাজিরা দেন প্রকৃত আসামি জয়নাল। মূলত এ সময়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নামের ভুল বা অন্য কোনো বিশেষ কারণে আসল আসামির বদলে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণ হারিয়েছেন নিরাপরাধ এক জয়নাল।

আসল আসামি মো. জয়নাল জানিয়েছেন, ‘আমাকে মারতে গিয়ে হয়তো জয়নাল নামে আমিন জুট মিল এলাকার একটি ছেলেকে পুলিশ মেরে ফেলেছে। হায়াত আছে বলে এখনও বেঁচে আছি। আমি মরে গেছি ভেবে পুলিশ চার্জশিট থেকেও নাম বাদ দিয়ে দেয়। যেহেতু বেঁচে আছি, তাই পুলিশ মামলা থেকে নাম বাদ দিলেও আদালতে আসামি হিসেবে হাজিরা দিয়ে জীবনকে রক্ষা করতে চাইছি।’

তবে পুলিশ যে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনাটি ভিন্নভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তার আভাস মিলেছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দীপংকর চন্দ্র রায়ের কথায়। তিনি বলেন, ‘যখন এ মামলার তদন্তভার নিই, তখন বায়েজিদ থানায় নতুন যোগদান করেছি। বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া জয়নালকে ভুল করে এ মামলার আসামি জয়নাল ভেবে চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছি।’

তাহলে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেল কোন্ জয়নাল— এমন প্রশ্নের জবাবে এসআই দীপংকর বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া জয়নাল খুবই বেপরোয়া প্রকৃতির তরুণ ছিল। তার বিরুদ্ধে দু-তিনটি মামলা রয়েছে বলে শুনেছি। তবে সে ছাত্র কিনা জানি না।’

আসল আসামি জয়নালকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত উল্লেখ করে মামলা থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগে দীপংকর চন্দ্র রায়কে গত ১ সেপ্টেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বায়েজিদ থানা থেকে তিনি চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানায় এসআই হিসেবে বদলি হয়ে এসেছিলেন। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার ঘটনাটি তদন্তের জন্য নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনারকে (উত্তর) নির্দেশ দেন।

‘পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ওই মামলার আসামি জয়নাল নয়, মারা গেছেন অন্যজন’— এমনটি নিশ্চিত করে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবিদ হোসেন বলেন, ‘মামলার ২ নম্বর আসামি আবদুল জলিলের ছেলে মো. জয়নালের বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার তথ্য চার্জশিটে তুলে ধরা হয়েছে। এ সংক্রান্ত কাগজপত্রও সিডিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে এখন দেখছি, ‘মৃত’ আসামি জয়নাল আদালতে হাজিরা দিচ্ছে।’

চট্টগ্রাম মহানগরের অতিরিক্ত এই পিপি বলেন, ‘৬ অক্টোবর মামলার পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারিত আছে। ওইদিন আদালতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এ ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনাটি আসলে কী ছিল, তার জুডিশিয়াল তদন্তের জন্য আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।’

এদিকে আসল আসামি জয়নাল জীবিত আছে এবং ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অন্য জয়নাল মারা গেছেন শুনে মামলার বাদি শাহ আলম মূল জয়নালকে আবার চার্জশিটভুক্ত করতে গত ৩ সেপ্টেম্বর আদালতে আবেদন করেছেন।

তবে এদিকে জয়নালের পরিবার ছাড়াও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, নামের মিল থাকায় পুলিশ ভুল করে নয়, জেনেশুনেই ক্রসফায়ারে দিয়েছে দশম শ্রেণির ছাত্র জয়নালকে। এর নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে স্থানীয় দুই নেতার আধিপত্যের দ্বন্দ্ব।

জানা গেছে, বায়েজিদের আমিন জুট মিল এলাকার আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব রয়েছে ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলী এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদুল ইসলাম বাবুর মধ্যে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত জয়নাল বাবুর অনুসারী হিসেবে সভা-সমাবেশে হাজির থাকতেন। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জয়নালকে যেদিন বায়েজিদের ভোকেশনাল অ্যান্ড টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের সামনের মাঠে ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়া হয়, তার আগের দিন আমিন জুট মিল এলাকায় মারামারি হয়।

জয়নালের স্বজনরা অভিযোগ করেন, ওই ঘটনায় জয়নাল জড়িত ছিলেন— এমন সন্দেহে কাউন্সিলর মোবারক আলীর কথিত পিএস সামসুসহ কয়েকজন রাতে জয়নালের বাসায় যান। তারা কিছুক্ষণ জয়নালের সঙ্গে কথা বলার পর তাকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করে একপর্যায়ে চলে যান। কিন্তু এরপর রাত একটার দিকে বায়েজিদ থানা পুলিশের একটি দল হঠাৎ বাসায় এসে জয়নালকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায়।

শিক্ষার্থী জয়নালের বাবা নুরুল ইসলাম ও মা জোহরা বেগম দুজনেই সুতা শ্রমিক। তিন মেয়ের পাশাপাশি ছেলে ছিল একটিই— জয়নাল। নগরীর আমিন জুট মিল কলোনি এলাকার বাসিন্দা জয়নালের বাবা বলেন, ‘কাউন্সিলর মোবারক আলীর পিএস সামসু বাসা থেকে যাওয়ার পরই পুলিশ ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর কাউন্সিলর মোবারক আলীর কাছে গিয়ে তার হাতে-পায়ে ধরেছি। তবুও তার মন গলেনি। কাউন্সিলর এ সময় বলেন, আমার ছেলের নামে নাকি বহু অভিযোগ। তার জন্য কিছু করতে পারবেন না।’

নুরুল ইসলাম বলেন, ‘মোবারকের কথা ছাড়া কিছুই হয়নি। আমরা গরিব মানুষ। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে চুপ করে আছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!