ইমান ছাড়া আমল মূল্যহীন। মহান আল্লাহর প্রিয় হতে হলে আখেরাতে মুক্তি পেতে চাইলে অবশ্যই প্রকৃত মুমিন হতে হবে। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সেরা ও সম্মানিত সৃষ্টি। মানুষের মধ্য থেকেই প্রেরণ করেছেন নবী-রাসূল। আল্লাহতায়ালা চান মানব জাতি সিরাতুল মুস্তাকিমে চলুক এবং এমন গুণাবলি অর্জন করুক যার ফলে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তিতে থাকতে পারবে। কিন্তু দুনিয়ার মানুষগুলো দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল তাদের স্রষ্টার কথামতো জীবন পরিচালনা করছে স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ মান্য করছে। আরেক দল তাদের স্রষ্টার কথামতো জীবন পরিচালনা করছে না স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ মান্য করছে না। যারা স্বীয় রবের নির্দেশ মতো জীবন পরিচালনা করছে তারাই হলো আল্লাহর বান্দাহ এবং কামিল মুমিন। ইমান অর্থ বিশ্বাস। মুমিন মানে বিশ্বাসী। তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসীকে মুমিন বলা হয়।
ইসলাম মানে আনুগত্য, মুসলিম অর্থ অনুগত ব্যক্তি, যিনি ইমানের সঙ্গে নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত এবং আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলেন। মুমিন ও মুসলিম জন্মগত ও বংশীয় পরিচয় নয় বিশ্বাস ও কর্মে তা অর্জন করতে হয়। দুনিয়ায় শান্তি ও পরকালে মুক্তির একমাত্র সহজ-সরল, সঠিক ও নিশ্চিত পথ ইসলাম। সফল ও সার্থক মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য কিছু গুণ বা শর্ত ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কোরআন হাকিমে যতগুলো সুসংবাদ রয়েছে তা এমন লোকদের জন্য যাঁদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে দুটি গুণ রয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের ভাষায় ‘আমানু ওয়া আমিলুস সলিহাত’ অর্থাৎ-যারা ইমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে। বিশ্বাস হলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন নবী কারিম (সা.) এর ভালোবাসা ও পরকালের প্রতি আকর্ষণ। এর ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয় আমালে সলিহ তথা নেক আমল বা সৎকর্ম। কোরআন ও হাদিসে প্রকৃত মুমিনের পরিচয় ও সফল মুমিনের উত্তম গুণাবলি বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
সব কাজ-কর্ম আল্লাহর মর্জি অনুযায়ী করে : কামিল মুমিনের প্রথম গুণ হলো তার বিশ্বাস চিন্তা-চেতনা ইচ্ছা-আকাংক্ষা এবং আচার-আচরণ সবই প্রভুর মর্জি মোতাবেক হয়। যেসব কাজ-কর্মে আল্লাহতায়ালা রাজি নন সেসব কাজ তারা আদৌ করে না।
জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে : কামিল মুমিনের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চক্ষু, কর্ণ, হাত-পা ইত্যাদি আল্লাহর সামনে হীন ও অক্ষম হয়ে থাকে। আল্লাহভীতির কারণে তারা বিনম্র হয়ে ও দুর্বলভাবে চলাফেরা করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-রহমানের (আল্লাহর) বান্দাহ তারাই যারা জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে। (সূরা ফুরকান : ৬৩)
অজ্ঞ লোকদের কথার জবাব কটু কথা দিয়ে দেয় না : কামিল মুমিন তারা যারা মূর্খদের জবাবে নিরাপত্তার কথাবার্তা বলে যাতে অন্যেরা কষ্ট না পায় এবং নিজেরা গুনাহগার না হয়। আল্লাহর বাণী-যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদের সম্বোধন করে (কটু কথা) বলে তারা এর প্রতিবাদ করে না ; বরং প্রশান্তিমূলক কথাবার্তা বলে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন-মন্দের জবাবে তাই বলুন যা উত্তম। (সূরা মুমিনুন : ৯৫)
নামাজে রাত কাটিয়ে দেয় : আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন-তারা রাত যাপন করে তাদের পালনকর্তার সামনে সিজদা করা অবস্থায় ও (নামাজে) দারানো অবস্থায়। (সূরা ফুরকান : ৬৪) রাতের নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদ অন্যতম। মহানবী (সা.)-বলেছেন নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ো। কেননা এটি তোমাদের পূর্ববর্তী সব নেক বান্দার অভ্যাস ছিল। এটি তোমাদের আল্লাহতায়ালার নৈকট্য দানকারী মন্দ কাজের কাফফারা এবং পাপাচার থেকে নিবৃত্তকারী।
সদা জাহান্নামের ভয়ে ভীত থাকে : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা সদা আল্লাহর আজাবের ভয়ে ভীত থাকে। আর আজাব থেকে বাঁচার জন্য তাঁর কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করে। আল্লাহ বলেন-কামিল বান্দাহ তারা যারা বলে হে আমাদের রব আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি হটিয়ে দিন। (সূরা ফুরকান : ৬৫)
অযথা ব্যয় করে না : কামিল মুমিন অযথা এবং না হক পথে ব্যয় করে না। আর ব্যয় করার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও কৃপণতা উভয়ই পরিহার করে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন-কামিল মুমিন হলো তারা যারা অযথা ব্যয় করে না এবং কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। (সূরা ফুরকান : ৬৭)
ইবাদতে শিরক করে না : শিরক তাওহিদের বিপরীত। তাওহিদ সব সৎকাজের মূল আর শিরক সব গর্হিত কাজের মূল। উভয় জগতের সৌভাগ্যের সোপান হলো তাওহিদ আর উভয়জগতের ধ্বংসের সোপান হলো শিরক। হজরত লোকমান (আ.) নিজের ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন হে বৎস! আল্লাহর সাথে (কাউকে) শরিক করো না। অবশ্যই শিরক মহা অন্যায়। (সূরা লোকমান : ১৪)
অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না : কামিল মুমিনের অন্যতম গুণ হলো সে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন-আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না। (সূরা ফুরকান : ৬৮) অন্য সূরায় ইরশাদ করেন-যে কেউ প্রাণের বিনিময় ছাড়া কাউকে হত্যা করল অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করার জন্য কাউকে হত্যা করল সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে কারো জীবন রক্ষা করল সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল। (সূরা মায়েদা : ৩২)
ব্যভিচার করে না : কামিল মুমিন স্বীয় জীবনকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখে। ব্যভিচার করা তো দূরের কথা এর ধারে-কাছেও যায় না। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই তা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সূরা বনি ইসরাইল : ৩২) অন্যত্র ইরশাদ করেন-কামিল মুমিন ব্যভিচার করে না। (সূরা ফুরকান : ৬৮)
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না : মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কবিরা গুনাহ। কারণ এর ফলে অন্যের প্রতি অবিচার ও জুলুম করা হয় এবং অনেক অঘটন ঘটে। মহানবী (সা.) বলেন কিয়ামতের দিন মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার জন্য জাহান্নামের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত সে পা নাড়ানোরও শক্তি পাবে না। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন-মুমিন হলো তারা যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না মিথ্যা ও বাতিল বৈঠকে বসে না। (সূরা ফুরকান : ৭২)
বাজে বৈঠকে বসে না : মুমিন যখন খারাপ ও বাজে বৈঠকের পাশ দিয়ে যায় তখন ভদ্রতা ও গাম্ভীর্য সহকারে চলে। তারা এরূপ বৈঠকে যোগদান করে না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) একদিন ঘটনাক্রমে খারাপ বৈঠকের পাশ দিয়ে যান। তিনি সেখানে না দাঁড়িয়ে সোজা চলে যান। মহানবী (সা.) এ কথা জানতে পেরে বলেন ইবনে মাসউদ কারিম তথা ভদ্র হয়ে গেছে।
স্বীয় পরিবারের জন্য দোয়া করে: মুমিন তার সন্তান-সন্ততি স্ত্রী পুত্র প্রমুখের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়া করে যেন তাদেরকে তার চোখের শীতলতাস্বরূপ করে দেন। হজরত হাসান বসরি বলেন চক্ষু শীতল করার অর্থ হলো-আল্লাহর আনুগত্যশীল করে দেয়া। পরিবারের কর্তার জন্য এটিই কাম্য যে তার সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রী, পুত্র আল্লাহর আনুগত্যশীল হওয়া, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকা এবং তার অনুগত হওয়া।
মুত্তাকিদের নেতা হওয়ার প্রত্যাশা করে : মুমিন অবশ্যই নেতা হতে চায়। তারা আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করে-হে আমাদের রব! আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতা করুন। অর্থাৎ আমাদেরকে এমন যোগ্য করে দিন যাতে মানুষ ধর্ম ও আমলে আমাদের অনুসরণ করে এবং জ্ঞান ও আমল দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়।
ঈমান হলো আন্তরিক বিশ্বাসের প্রতিফলন আর যিনি কাজে কর্মে এ বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটান তাঁকে মুমিন বলা হয়। কোনো মানুষের ভেতর চারটি গুণ থাকলে পরকালে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন চারটি গুণ এতই মূল্যবান তা যদি তোমার মধ্যে থাকে তাহলে দুনিয়ায় আর কী তোমার নেই সে চিন্তা করার দরকার নেই : ১. আমানত রক্ষা করা, ২. সত্য কথা বলা, ৩. উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া, ৪. রিজিক হালাল হওয়া। আসুন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে আমাদের স্বভাব-চরিত্র মিলিয়ে নিই। যদি মিল পাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি ; আর যদি অমিল পাই তওবা করে তা সংশোধনে সচেষ্ট হই। দাওয়াত, তাবলিগ ও তালিমে মনোনিবেশ করি। নিজে বাঁচি, স্বীয়পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, আপনজন ও প্রিয়জনকে বাঁচাই। তবেই সমাজ অপরাধমুক্ত হবে দুনিয়ায় জান্নাতি সমাজ কায়েম হবে।
মুমিন তাকে বলা হয় যিনি আল্লাহতায়ালাকে একইসঙ্গে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন আবার সবচেয়ে বেশি ভয় পান। একজন মুমিনের ধ্যান-জ্ঞান ইচ্ছা-অভিলাষ সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হবেন এক আল্লাহ। আল্লাহর নির্দেশনাবলী সে এমনভাবে মান্য করবে যেন এটাই তার অভ্যাস-আল্লাহর চাওয়াই তার চাওয়া আল্লাহকে পাওয়াই তার পাওয়া। একমাত্র চিত্তের বিশুদ্ধতা অর্জনের মাধ্যমেই সফলতা তথা ইহজাগতিক শান্তি ও পরজগতে মুক্তিলাভ সম্ভব। মুমিন সবসময় মনে রাখবে আল্লাহ তার পর্যবেক্ষণে আছেন। সবসময় সবকাজে কিয়ামত দিবসের মালিকের সামনে জবাবদিহি করতে হবে এই চিন্তা রাখবে। এবং আল্লাহতাআলা তাকে যেই নেয়ামত দিয়েছেন তার শুকুর গুজার হবে। আল্লাহ আমাদের সত্যিকারের মুমিন হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট