কোনটি ঠিক, কোনটি বেঠিক— করোনাভাইরাস নিয়ে প্রচলিত মিথ

আমাদের মধ্যে সবাই জীবনে একবার অন্তত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি। হ্যাঁ আমরা সবাই। শুনতে অদ্ভূত ঠেকছে না? খুলে বলছি। করোনাভাইরাস আসলে শত শত ভাইরাসের একটি পরিবার। এজন্য এটিকে এনভেলপ্ট ভাইরাসও বলা হয়। ১৯৩০ সালের দিকে ভাইরাসটির প্রথম জন্ম হয়েছিল। মানুষ প্রজাতির যে করোনাভাইরাস ছিল সেটি ছিল সাধারণ ঠাণ্ডা কাশির মতোই। আক্রান্ত হলে সাধারণ ঘরোয়া চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে। মানুষ প্রজাতির করোনাভাইরাস মানুষের জন্য ভয়ংকর ছিল না।

১৯৩০ সাল থেকেই অন্য প্রাণির শরীরেও ছিল করোনাভাইরাস। বেশিরভাগ সময়ে বাদুড়, মুরগি, উট এবং বিড়ালরা সংক্রমিত হয়েছিল। মাঝে মাঝে একটি প্রজাতিতে সংক্রমিত ভাইরাসগুলো এমনভাবে পরিবর্তিত হতে পারে বা হয়ে যায় যা অন্য প্রজাতিকেও সংক্রমিত করে। এটিকে ‘ক্রস-প্রজাতি সংক্রমণ’ বা ‘স্পিলওভার’ বলা হয়। স্পিলওভার হওয়া ভাইরাসটিই ভয়ানক হয় মানবদেহের জন্য। করোনাভাইরাস ভয়ংকররূপে দেখা দিয়েছিল সার্স ও মার্সরূপেও। এটি তৃতীয়বার ধরণ পাল্টে হয়েছে ‘নভেল করোনাভাইরাস’ বা ‘সার্স কোভ -২’ সবশেষে এটির নামকরণ হলো কোভিড-১৯।

নভেল করোনাভাইরাস এমন একটি ত্রাসের নাম— যা কয়েকমাসে পুরো পৃথিবীর মানুষের জীবনকে থমকে দিয়েছে। এটির চিকিৎসা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি এখনও। সে কারণেই গ্রহণযোগ্য বা প্রমাণিত কোন চিকিৎসা পদ্ধতিই নেই। আমাদের সামনে রয়েছে কিছু গবেষণাপত্র বা কিছু সংবাদ। এগুলো চূড়ান্তরূপে করোনা চিকিৎসায় অনুমোদন পায় কী না সেটি দেখার বিষয়।

যে বিষয়টি যত অবোধ্য তা নিয়ে সত্যের চেয়ে অনেক বেশি মিথ প্রচারিত হয়ে যায়। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আতংকের মুহূর্তে কোনটি মিথ কোনটি সত্য সেটি বোঝা যায় না। বিভিন্ন মেডিকেল জার্নাল ও খবরমাধ্যমে প্রকাশিত গবেষণার মাধ্যমে মিথগুলোকে যাচাই করা প্রয়োজন। সবসময় মনে রাখতে হবে নিজে নিজে কোন চিকিৎসা নেওয়া যাবে না। সেলফ মেডিকেশন খুবই ভয়ানক হতে পারে।

করোনাভাইরাস কি জ্বর-সর্দি-শ্বাসযন্ত্রের সাধারণ অসুস্থতা?
এটি আংশিক সত্য। তবে এতটাই সরল নয় কোভিড-১৯। জ্বর সর্দি কাশিতে এটি নিজের উপস্থিতি জানান দিলেও কোভিড সংক্রমণের লক্ষণ দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। বিশ্বে কোভিড-১৯ আক্রান্ত অর্ধেকের বেশি রোগীর জ্বর সর্দি-কাশির সাথে বমি ও ডায়রিয়াও ছিল। এবং কিছু রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে গিয়েছিল। কেননা তাদের জিআই উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। ‘জিআই’ হলো শরীরে ফোলাভাব, পেটে গ্যাস হওয়া, বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য। বর্তমানে যে উপসর্গটি লক্ষ্যণীয় তা হলো কোভিড-১৯ এর রোগী ঘ্রাণ ও স্বাদ নেওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হলো সাধারণ উপসর্গগুলো না থাকলেও বলা যায় না আপনি কোভিড আক্রান্ত নন।

যেহেতু আমার কোন উপসর্গ নেই, সেহেতু আমি সংক্রমিত নই?
উপসর্গ না থাকলেও আপনি করোনা পজেটিভ হতে পারেন। সাধারণত উপসর্গ দেখা দিতে ৫-১৪ দিন লাগে। করোনাভাইরাস যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার কোষে যথেষ্ট সংখ্যায় নিজেকে কপি করতে না পারছে ততক্ষণ আপনার উপসর্গ দেখা দেবে না। অর্থাৎ আক্রান্ত করতে হলে করোনাভাইরাসকে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার নিজের প্রতিলিপি বানাতে হবে। এরজন্য তার ৫-১৪দিন সময় লাগে। অনেকের ক্ষেত্রে মানুষটিকে ধরাশায়ী করতে দুদিনই যথেষ্ট। যদি করোনাভাইরাস নিজের প্রতিলিপি বানাতে অকৃতকার্য হয় । তাহলে রোগের উপসর্গ দেখা যাবে না। অর্থাৎ ইমিউনিটি ভাল হলে তাহলে প্রারম্ভেই ঠেকিয়ে দেবে করোনাকে।

এন-৯৫ মাস্ক কোভিড থেকে সুরক্ষা দেবে?
নাক মুখ ও চিবুকের চারপাশটা ভালভাবে বন্ধ থাকলে সেটি আপনাকে ৯৫ শতাংশ সুরক্ষা দেয় বায়ুবাহিত রোগ থেকে। কোভিডের ক্ষেত্রেও এটি কিছুটা স্বস্তির খবর দিলেও শুধু মাস্ক পরেই কোভিডকে দমানো যাবে না। কারণ ভাইরাসটি হাঁচি কাশির ড্রপলেট থেকে চোখ হয়ে প্রবেশ করতে পারে। অথবা ভাইরাসছোঁয়া হাতটি যখন চোখ বা মুখে যাবে তখনও সেটি শরীরে প্রবেশের সুযোগ থাকছে। সুতরাং একটি এন-৯৫ মাস্ক কোভিডকে পুরোপুরি দমাতে পারে তা বলা যাচ্ছে না।

অ্যালকোহল গ্রহণ করলে কি করোনাভাইরাস ধ্বংস হবে?
উত্তর হলো, না। অ্যালকোহল পান করলে আপনি করোনাকে প্রতিরোধ করতে পারবেন না। বা অ্যালকোহল কোন প্রতিষেধকও নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। ইরানে এরকম অ্যালকোহল পান করে অনেকেরই মৃত্যু ঘটেছে।

নিউমোনিয়া বা ফ্লুর ভ্যাকসিন কি করোনা দমন করতে পারবে?
না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে নিউমোনিয়া, নিউমোক্কাল বা ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন আপনাকে নতুন করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে না। নতুন করোনাভাইরাসের গঠন ও প্রকৃতি এতোই আলাদা যে এটির জন্য সম্পূর্ণ পৃথক ভ্যাকসিন প্রয়োজন।

অ্যান্টিবায়োটিকগুলো কি করোনাভাইরাস চিকিৎসায় কার্যকর?
ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা মোটেও সমীচিন নয়। কারণ অ্যান্টিবায়েটিক কেবলমাত্র ব্যকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসায় কার্যকর। তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারে কারণ ভাইরাসের সাথে ব্যকটেরিয়াও যাতে সংক্রমণ করতে না পারে। তবে অ্যান্টিবায়োটিক কোনক্রমেই কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা নয়।

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কোন্ ওষুধ ব্যবহার হবে তা কি ঠিক হয়েছে?
২০১৯- এ জন্ম নেওয়া নতুন করোনাভাইরাসের জন্য আসলে কোন নির্ধারিত ওষুধ নেই। বা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। এখনও পর্যন্ত কোভিড রোগীদের পর্যবেক্ষণে রেখে উপসর্গ অনুসারে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

সংক্রমিত হলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন কারা?
যারা দীর্ঘদিন ফুসফুসের রোগে ভুগছেন, যাদের মাঝারি বা গুরুতর পর্যায়ে হাঁপানি আছে, যারা হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগে ভুগছেন, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষীণ (ইমিউনোকম্প্রাইজড), যারা অতিরিক্ত স্থুল (ওবেসিটি), যাদের ডায়াবেটিক আছে, দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভুগছেন যারা বা যাদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়।

‘ইমিউনোকম্প্রাইজড’ হওয়ার অর্থ যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ শরীরকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে জন্য নির্দিষ্ট রক্তকণিকা পর্যাপ্ত পরিমাণে উত্পাদন করতে না পারা। এ অবস্থা তৈরি হতে পারে কোনও রোগ দ্বারা অথবা কোনও ওষুধের মাধ্যমে। এমন মানুষদের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং গুরুতর অসুস্থতার ঝুঁকি রয়েছে। তবে অনেকে আবার অপুষ্টিজনিত কারণে জন্মের সময়ই ইমিউনোডেফিশিয়েন্সির সাথে জন্ম গ্রহণ করে থাকে।

কখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষীণ (ইমিউনোডেফিশিয়েন্ট) হতে পারে?
যেকোন ধরনের ক্যান্সার আপনাকে ইমিউনোডেফিশিয়েন্ট হিসাবে তৈরি করতে পারে। যারা ওই ক্যান্সার সারাতে কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি নিয়েছেন সেই থেরাপিটিও আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার কারণ। এছাড়াও সাইক্লোস্পোরিন, কর্টিকোস্টেরয়েডস জাতীয় ওষুধ আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দিতে পারে।

যাদের ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণ, মাইকো ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ (যেমন যক্ষ্মা) এবং ভাইরাল সংক্রমণসহ কোনও সংক্রমণ (উদাহরণস্বরূপ, এইচআইভি / এইডস, হাম, হার্পস, গ্রন্থি জ্বর ও চিকেনপক্স) হয়েছিল। যে কোন ধরনের ডায়াবেটিক- টাইপ ১ বা টাইপ ২, কিডনি ফেইলিউর, লিভার সিরোসিস এবং লিভার ফেইলিউরের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ থাকলে। পরিবেশ থেকে নির্গত টক্সিনও কমিয়ে দেয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে। এছাড়াও গর্ভাবস্থা ও বেশি বয়সের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।

উচ্চ রক্তচাপ হলে কী করা উচিত?
ব্যায়াম করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। চিকিৎসকের নির্দেশিত ওষুধ থাকলে সেটি চালিয়ে যেতে হবে।

ভিটামিন সি কি করোনা প্রতিরোধী?
চাইনিজ জার্নাল অফ ইনফেকশন ডিজিজে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে, সাংহাই মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন কোভিড -১৯ আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ব্যক্তিদের চিকিত্সা হিসাবে উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি ব্যবহারের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে। যদিও উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি বর্তমানে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফুসফুসের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে কী না তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এখনও এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি এই রোগে কোনরকম সহায়তা করতে পারে।

ইমিউনিটি বাড়াতে ভিটামিন সি-এর ভূমিকা আছে সেটি অস্বীকার করা যায় না। মুখের মাধ্যমে (ওরালি) দৈনিক ৭০ গ্রামের বেশি ভিটামিন সি গ্রহণ করা মোটেও নিরাপদ নয়। এটি ডায়রিয়ার ছাড়াও বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। ৭০ গ্রাম ভিটামিন সি আপনি পেতে পারেন লেবু, কমলা, আমলকি বা টমেটো থেকে। দৈনিক দুটির বেশি মাল্টা বা লেবু খাওয়ার প্রয়োজন নেই। আতংকে অনেক কিছু কিনে ফেলারও (প্যানিক বায়িং) প্রয়োজন নেই ।

জিংক গ্রহণ করলে করোনা হবে না?
না। এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলে বসেছিলেন যে জিংক করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। প্রথমেই বলে রাখতে হয় করোনাভাইরাসের স্বীকৃত বা অনুমোদিত কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। সবকিছুই এখনও পরীক্ষামূলক। রোগীকে অবজারভেশনে রেখে উপসর্গ অনুসারে বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কোথাও ফল মিলছে। কোথাও মিলছে না। শতভাগ প্রমাণিত কিছু নেই। মার্কিনিরা ও ইউরোপে চিকিৎসায় জিংক ব্যবহারের মেডিকেল ট্রায়াল শুরু হয়েছে।

জিংক জিনিসটা আসলে কী?
জিংক হলো প্রকৃতিতে পাওয়া একটি খনিজ। জিংক আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করে, প্রোটিন সংশ্লেষণ, ক্ষত নিরাময়, ডিএনএ সংশ্লেষণ এবং কোষ বিভাজনে ভূমিকা পালন করে। হাঁস-মুরগি, ফলমূল, বাদাম, পূর্ণশস্যে এটি থাকে। খাদ্য থেকে জিংক গ্রহণে কোন অসুবিধে নেই। তবে ওষুধ সাপ্লিমেন্ট হিসেবে জিংক গ্রহণ করলে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটি করবেন না।

ভিটামিন ডি কি করোনাকে রুখতে পারে?
প্রথমেই মনে রাখতে হবে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট আপনাকে কোভিড-১৯ এর বিকাশ থেকে রক্ষা করতে পারে এমন কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তবে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হওয়ায় ইমিউন ফাংশন ক্ষতিগ্রস্ত করে। যে কোন রোগের সংক্রমণ এবং রোগের প্রতি সংবেদনশীলতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। খাদ্য থেকে ভিটামিন ডি গ্রহণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্রতিরোধ ক্ষমতা যে কোন অসুখ থেকে সারিয়ে তুলতে উপকারী ভূমিকা রাখে।

সবশেষ কথা হলো নিশ্চিত চিকিৎসা নেই এখনও। সেজন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm