চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানার মাইজপাড়া মাহমুদুন্নবী চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এমএ কাশেমের বিরুদ্ধে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আদায় করা অর্থের হিসেব মিলাতে গিয়ে আয়-ব্যয়ের খাতায় ঘষামাঝারও প্রমাণ মেলেছে অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে।
প্রায় এক যুগ ধরে চট্টগ্রামের এ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত এমএ কাশেম। প্রতিবছর তিন ক্যাটাগরির বোর্ড পরীক্ষায় নির্ধারিত ফি ছাড়াও শিক্ষার্থীদের কাছ আদায় করতেন তিনি অতিরিক্ত ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা।
তার বিরুদ্ধে ওঠা ১৯টি অভিযোগের মধ্যে তদন্ত কমিটির ১৫টি অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে। তার বিরুদ্ধে ৭৩ লাখ ৫২ হাজার ৭০৯ টাকার অভিযোগ আনা হয়। অনিয়মের ঘটনা প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. আলীর একক আধিপত্যে প্রতিবছর ওই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে পিএসপি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আদায় করতেন প্রধান শিক্ষক এমএ কাশেমে ও হিসাব সহকারী রতন কুমার দাশ। আদায় করার টাকার পরিমাণ প্রায় ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা।
শিক্ষাবোর্ডের নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া ছাড়াও নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রতিজন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হত অতিরিক্ত ২৫০০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যেসব শিক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় কয়েক বিষয়ে অকৃতকার্য হতো তাদের কাছ থেকে শর্ত সাপেক্ষে জামানত হিসেবে নেওয়া হতো আরও অতিরিক্ত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
পরবর্তীতে পরীক্ষায় পাশ করলে টাকা ফেরত নিতে আসলে স্যারদের মিষ্টি খাওয়ানোর অজুহাতে জামানতের সে টাকা আর ফেরত দেওয়া হতো না।
ওই বিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর তাদের শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্য বিদ্যালয় থেকে পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতো প্রায় দেড় হাজার পরীক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বোর্ড নির্ধারিত ফি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হতো। সেই হিসেবে প্রতিবছর দেড় হাজার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হতো অবৈধভাবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা।
চলতি বছরের ৬ অক্টোবর বিদ্যালয়ের এসব অনিয়মের ঘটনায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এমএ কাশেমকে বরখাস্ত করা হয়। আগামী ১ নভেম্বরের মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষককে জবাব দিতে বলা হয়। সঠিকভাবে জবাব দিতে না পারলে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে স্থানীয় বহিস্কার করা হবে বলেও জানিয়েছে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা।
জানা যায়, ২০০৭ সালের ১ মার্চ মাইজপাড়া মাহমুদুন্নবী চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এমএ কাশেম। শুরু থেকে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন আয় ও ব্যয়ের খ্যাত থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে সর্বমোট ৭৩ লাখ ৫২ হাজার ৭০৯ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও এডহক কমিটি মোট ১৯টি অভিযোগ আনে। তার মধ্যে ১৫টি অভিযোগই প্রমাণিত হয়।
এরপর বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকদের চাকুরি শর্ত ১৯৭১ এর (এ) ও ১৩ (১) ধারা এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রবিধান ৩৯ এর অধীনে ২ ও ৩ ধারা অনুসারে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওইদিনই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু শাকের মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুমকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক এমএ কাশেম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কমিটির লোকেরা একজোট হয়ে মিথ্যা অপবাদ টেনে আমাকে বরখাস্ত করেছে। অথচ, ২০০৭ সাল থেকে অবহেলিত এই স্কুলটিকে পতেঙ্গার একটি মডেল স্কুল হিসেবে দাড় করিয়েছি। এটির কৃতজ্ঞতা কারও কাছ থেকে পাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্কুলের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা বোর্ড পরীক্ষা দেয়ার মাধ্যমে অভিভাবকদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু আমার স্কুলের ফান্ড থেকে এক টাকাও আমি নয়-ছয় করিনি। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন।’
মাইজপাড়া মাহমুদুন্নবী চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি মো. লোকমান বলেন, ‘একজন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রায় ১৯টি অভিযোগের মধ্যে ১৫টি অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয় তদন্তে। প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে তিনি ফি আদায় করতে। ২০০৮ সাল থেকে এই স্কুলের অধীনে প্রতিবছর পিএসপি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় এক হাজারের অধিক বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী অংশ নিতো। বোর্ডের নির্ধারিত ফি ছাড়াও তিনি অতিরিক্ত টাকা আদায় করতেন। যা সম্পূর্ণ অবৈধ। সম্প্রতি এসব অভিযোগ এনে প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আগামী নভেম্বর এ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
মাইজপাড়া মাহমুদুন্নবী চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. আলী বলেন, ‘অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো দৃশ্যমান নয়। অদৃশ্যমান অনিয়ম নিয়ে আমি কথা বলব না। ওনার মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। আর মাত্র একবছর রয়েছে। এখন এসব অভিযোগ একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তার পেটে লাথি মারা ছাড়া আর কিছু নই।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আ.স.ম জামশেদ খোন্দকার বলেন, ‘আমি নতুন আসছি এ দায়িত্বে। আপনার বিষয়টি নোট নিলাম। আমি দেখছি।’
মুআ/এমএফও