কুকুর গ্যাংয়ের আতঙ্কে মানুষ, ২ বছরে ৩ শতাধিক আহতের বেশিরভাগই শিশু

ভ্যাকসিন না মেলায় মানুষ যায় বৈদ্যের কাছে

রীতিমতো দলবদ্ধ হয়ে কিছু ঘোরে দিনের বেলায়, অল্পতেই তারা মানুষকে আক্রমণ করে। এদের সবচেয়ে সহজ শিকার শিশুরাই। আবার কুকুরদের বড় একটি অংশ দিনের বেলায় থাকে লোকচক্ষুর আড়ালে, কিন্তু রাতের বেলায় তারা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। দলবেঁধে হামলা চালায় গবাদিপশুর খামারে।

রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে এভাবে বেড়ে গেছে বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব। এসব কুকুরের কামড়ে গত দুই বছরে তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। সর্বশেষ গত তিন মাসে কুকুরের কামড়ের শিকার হয়েছে ৫০ জনেরও বেশি লোক। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, কুকুরের আক্রমণের শিকার হচ্ছে শিশুরাই বেশিরভাগ। অন্যদিকে শতাধিক শতাধিক গবাদিপশুর তাদের খাবারে পরিণত হয়েছে।

এদিকে উপজেলায় ভ্যাকসিন না থাকায় কুকুরে কামড়ে আহত মানুষকে ভ্যাকসিন নিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ সূত্র জানায়, গত দুই বছরে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কুকুরের কামড়ে আহত তিন শতাধিক মানুষকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিতে হয়েছে। এর বাইরেও অনেকে বৈদ্য কবিরাজের চিকিৎসা নিয়েছে। গত দুই বছরে যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে তার মূল্য ৬ লাখ ৮ হাজার টাকা।

বাঘাইছড়ি পৌর মেয়র জাফর আলী খান বলেন, কুকুরের উপদ্রব বাড়ায় কুকুর থেকে সাবধান থাকতে পৌর এলাকায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে সচেতনতার পাশাপাশি স্থানীয়দের সতর্ক করছে পৌর কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও পৌরসভা এলাকায় বেওয়ারিশ প্রায় ২০০ কুকুরকে ভ্যাকসিন দিয়ে রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমাদের এলাকায় যে হারে কুকুরে উপদ্রব বেড়েছে ভ্যাকসিন মজুদ রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ভ্যাকসিন মজুদ নেই। আর এসব কুকুর দিনের বেলায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও রাতে সংঘবদ্ধভাবে মানুষের গবাদিপশুর খামারে হামলা করে।

কুকুর গ্যাংয়ের আতঙ্কে মানুষ, ২ বছরে ৩ শতাধিক আহতের বেশিরভাগই শিশু 1

বাঘাইছড়ি প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের উপসহকারী কর্মকর্তা প্রণয় খীসা চাকমা বলেন, বছরের এ সময় সাধারণত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে কুকুরের উপদ্রব বেশি থাকে। এসব কুকুর অল্পতেই মানুষকে আক্রমণ করে। গত দুই বছরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেওয়ারিশ কুকুরের কামড়ে শতাধিক গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি মারা গেছে শুধু কুকুরের কামড়ে।

কেবল জলাতঙ্কই নয়, ধনুষ্টঙ্কারসহ বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগও কুকুরের আঁচড় বা কামড় থেকে ছড়াতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে জলাতঙ্ক যেমন প্রাণসংশয়ের কারণ হতে পারে, তেমনই আক্রান্ত স্থানে বিবিধ সংক্রমণ ছড়িয়ে সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। জলাতঙ্কের পাশাপাশি ধনুষ্টঙ্কারের সংক্রমণ ঠেকাতে কুকুরের আক্রমণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ধনুষ্টঙ্কারের টিকা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

উপজেলা পরিষদে ভ্যাকসিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মা ফার্মেসির সুজিৎ চক্রবর্তী বলেন, ‘গত দুই বছরে ৩০০ মানুষকে ৬ লাখ ৮ হাজার টাকার ভ্যাকসিন দিয়েছি। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের সুপারিশপত্র অনুযায়ী ৩ থেকে ৫টি করে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। কিন্তু দুই বছরে ভ্যাকসিনের জন্য টাকা পেয়েছি মাত্র ২ লাখ টাকা। বর্তমান পরিষদের কাছে আরো ৪ লাখ ৮ হাজার টাকা এবং এর আগের পরিষদের চেয়ারম্যান বড় ঋষি চাকমার কাছে এক লাখ ৪৯ হাজার টাকাসহ মোট ৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বকেয়া পাওনা আছি।’

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা বলেন, ‘কুকুরের কামড়ে আক্রান্তদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই ভ্যাকসিন নিয়েছেন। উপজেলায় বর্তমানে ভ্যাকসিন সংকট থাকায় শুধুমাত্র গরিব ও অসহায় মানুষদের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।’

সুদর্শন চাকমা বলেন, ‘সচেতনতার অভাবে অনেকে বৈদ্য কবিরাজের কাছে গিয়ে জলাতঙ্ক রোধের দাওয়াই নিচ্ছে। এটা না করতে আমরা বারবার সচেতন করছি। এখন আক্রান্তরা আমাদের কাছে আসছে। কিন্তু আমরা ভ্যাকসিন দিতে পারছি না।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘ভ্যাকসিনের বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। আমাদের কাছে ভ্যাকসিনও নেই। যারা কুকুড়ের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে আমাদের কাছে আসে, তাদের খাগড়াছড়ি জেলা শহরে পাঠিয়ে দিই। সেখানে গিয়ে ভ্যাকসিন নিতে হয়। এ ভ্যাকসিনটি সাধারণত প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে দেওয়া হয়। উপজেলা পর্যায়ে এখনও দেওয়া হয় না। কুকুড়ের কামড় খেলে আমাদের কাছে মানুষ আসে না। এরা সম্ভবত চেয়ারম্যানের কাছে যায়। সরকার এটা আমাদের হাতে দিলে তখন মানুষকে সেবা দিতে পারব।

এদিকে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল কাইয়ুম বলেন, গত দুই বছরে আমি নিজে দুই শতাধিক মানুষকে ভ্যাকসিনের জন্য সুপারিশ করেছি। প্রতিনিয়ত মানুষ ভ্যাকসিনের জন্য আসে। কিন্তু আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!