কালুরঘাটে রেলসেতুর সঙ্গে হবে ঝুলন্ত সেতু— প্রধানমন্ত্রীর বার্তা
সংসদ থেকে স্থানীয় এমপির পদত্যাগ নয়, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কালুরঘাটে দ্বিমুখী রেল সেতুর পাশাপাশি সড়কপথের জন্য আরেকটি ঝুলন্ত সেতুর নির্মাণ কাজ শিগগিরই দৃশ্যমান হবে—এমন কথাই চট্টগ্রামবাসীকে জানিয়ে দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তাটি খুব শিগগিরই নিজ মুখে ঘোষণা আসবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। এরপরও বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য ও দলের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে ঘোষণা দিতেও বলেছেন তিনি।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি ও মইন উদ্দিন খান বাদল এমপি দুজনেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি আর বাদল (মইন উদ্দিন খান বাদল এমপি) সম্প্রতি গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। তখন কালুরঘাট সেতুর বিষয়টি শুধু বাদলের পদত্যাগ বা তার ব্যক্তিগত ইস্যু নয় আর জনদাবিতে পরিণত হয়েছে বলে জানানো হয় প্রধানমন্ত্রীকে। বিষয়টি তিনি নিজেও অবগত আছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। এ সময় আমি কালুরঘাটে নতুন সেতুর বিষয়টি নেত্রীর কাছে তুলে ধরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তখন নেত্রী জানিয়েছেন, কালুরঘাটে নতুন করে একটি ডাবল লাইনের ব্রডগেজ ডেডিকেটেড রেল সেতু নির্মাণ করা হবে। একই সঙ্গে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ইলেকট্রিক রেল সার্ভিসের জন্য রেল লাইনকে উপযোগী করে নির্মাণ করা হচ্ছে। সে কারণে কালুরঘাটে ডেডিকেটেড সেতু এমনিতেই হবে। এ সময় স্থানীয় এমপি মইন উদ্দিন খান বাদল নেত্রীর কাছে জনগণের প্রাণের যে দাবি সড়ক সেতু সেটি তুলে ধরেন। তখন নেত্রী বলেন, ডেডিকেটেড রেল সেতুর পাশাপাশি প্রয়োজনে জনমানুষের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করা হবে।’
সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, ‘এর ব্যাখ্যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রেল সেতুর পাশাপাশি কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর আর কোনও সেতু করা যাবে না। নদীর নাব্যতা রক্ষায় রেল সেতুর পাশেই একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করা হবে একই সময়ে। যেটি শুধু সড়কপথ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।’
কবে এ প্রক্রিয়া শুরু হবে জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘উনি আগামী একনেক বৈঠকে সেতুর ডিজাইন সম্পর্কে আলোচনা করবেন। আমাকে ও বাদল সাহেবকে বিশেষ আমন্ত্রণে থাকতে বলেছেন। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশনা দেবেন। উনি যেহেতু বলে দিয়েছেন তাহলে সেখানে না হওয়ার তো কিছুই নেই। এ বছরের মধ্যেই একটি দৃশ্যমান অগ্রগতি হবে আশা করি। আর বাদল সাহেবকে পদত্যাগও করতে হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’
একই কথা জানিয়েছেন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কালুরঘাট সেতুর দৃশ্যমান অগ্রগতি না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগের হুমকি দেওয়া চট্টগ্রাম ৮ আসনের সংসদ সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদলও। এমনকি তিনি এই সেতুর বিনিময়ে জীবন সায়হ্নে এসে নিজ দল ত্যাগ করে আওয়ামী লীগে আসার কথাও বলেছেন। এমনই সময়ে সম্প্রতি গণভবনে ডাক পড়ে এমপি বাদলের। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী কথা বলেছেন তার বিস্তারিত জানিয়েছেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে।
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে আমার শরীরের অবস্থা জানতে চেয়ে শারীরিক যত্ন নিতে বললে, মোশাররফ ভাই বলেন, নেত্রী ওনার শরীরের কি যত্ন নেবেন? ওনার মাথা তো আউট হয়ে গেছে! উনি ঘুমানোর সময় কালুরঘাট সেতু, জাগ্রত অবস্থায়ও কালুরঘাট সেতু নিয়ে চিন্তা করেন। এখন নতুন কথা শুরু করছে ব্রিজ না হলে পদত্যাগ করবেন।’
‘এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সামনে থাকা একটি ছোট টেবিলে পরপর তিনবার টেবিল চাপড়ে বলেন, আমি তো ওনাকে বলেছি, আমি ব্রিজ করব, করব, করব। তিনি আমাকে রেল কাম সড়ক সেতু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সুতরাং কালুরঘাট ব্রিজ নিয়ে ধোঁয়াশা কেটে গেছে।’
এমপি বাদল আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে আমি বলেছি, ব্রিজ না হলে আমার এলাকার মানুষের সামনে আমি কী মুখ নিয়ে যাব? আমার মৃত মাকে গালি শোনানোর জন্য তো আমার এমপিগিরি করার দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনি আর মোশাররফ সাহেব এলাকায় বলে দেন, ব্রিজ হবে। আগামী মিটিংয়ে কালুরঘাট ব্রিজ এর ডিজাইন নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।’
এদিকে সড়ক সেতু নিয়ে রেলভবনের প্রস্তুতি না থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর আগের প্রস্তাবিত কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুটি থেকে সরে এসে শুধুমাত্র ডেডিকেটেড দুইমুখী রেল সেতু নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যেটি হবে ব্রডগেজ রেল সেতু। ইতোমধ্যে কোরিয়ান দাতা সংস্থা ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ডের (ইডিসিএফ) সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ওই দাতা সংস্থাকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের সমীক্ষার কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমান সরকারের সদিচ্ছায় প্রস্তাবিত চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের
সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং কর্ণফুলী নদীর ওপর পুরানো কালুরঘাট রেল সেতু ভেঙে নতুন করে পৃথক রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ সেতুটি সরকারের মেগা প্রকল্প দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইনের অন্তর্ভুক্ত।
শত বছরের ভারে ন্যুব্জ সেতু কালুরঘাট
জানা গেছে, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সৈন্য পরিচালনার জন্য ১৯৩০ সালে কর্ণফুলী নদীতে একটি আপৎকালীন সেতু নির্মাণ করা হয়। ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স হাওড়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে ৭০০ গজের সেতুটি তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মোটরযান চলাচলের জন্য সেতুতে ডেক বসানো হয়। ১৯৫৮ সালে এই এক লেনের সেতুটিই সব ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বয়সের ভারে এখন ন্যুব্জ এই সেতু। ফলে ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে হাজার হাজার মানুষ। এ অবস্থায় সেতু ব্যবহারকারী বোয়ালখালী উপজেলা ও পটিয়ার একাংশের বাসিন্দারা একই স্থানে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান নতুন সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই করে।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কালুরঘাট রেল ও সেতুটি জরাজীর্ণ হওয়ায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে এবং বর্তমান সরকারের সদিচ্ছায় প্রস্তাবিত চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং কর্ণফুলী নদীর ওপর পুরানো কালুরঘাট রেল সেতু ভেঙে নতুন করে রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ সেতুটি সরকারের মেগা প্রকল্প দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইনের অন্তর্ভুক্ত।
সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কালুরঘাট কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল ও সড়ক সেতু নামে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে ঢাকাস্থ রেলভবন কার্যালয়ে পাঠায়। পরে সেটি যাচাই-বাছাই শেষে কয়েক দফা পুনর্গঠন করে ২৭ মার্চ সংশোধিত ডিপিপি রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হয়।
প্রকল্প অনুসারে ২০২০ সালের শুরুতে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৬৪ কোটি ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকার দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ)। বাকি টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।
রেল কর্মকর্তাদের মতে, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের যে প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে, তার সুফলও নির্ভর করছে কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের ওপর।