কারাবাসের বিনিময়ে পড়তে হবে বই, দেখতে হবে এতিমদের
চকরিয়ায় বিচারকের ব্যতিক্রমী রায়
মামলায় দোষী প্রমাণিত হলেও কারাগারে যেতে হচ্ছে না সাজাপ্রাপ্ত ষাটোর্ধ্ব এক আসামিকে। এ এক অন্যরকম সাজা। ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলেও কারাবাসের বদলে এই আসামিকে পড়তে হবে বই, খাওয়াতে হবে এতিমদের, নিয়মিত পড়তে হবে নামাজও— এমন ১২টি শর্ত মানতে হবে এই আসামিকে।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার একটি আদালতে অভিনব এ রায় দেওয়া হয়েছে। চকরিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার দেব আসামির বয়সসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে তাকে সংশোধনের সুযোগ দিতে এ রায় দিয়েছেন।
মামলার রায়ে বিচারক বলেছেন, ‘সুলতান আহমেদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৮৬০-এর ৪২০ ধারায় গঠিত অভিযোগটি প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ৪০৬ ধারার অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। আসামির বয়স ৬৪-৬৫। তিনি যথেষ্ট অর্থবিত্তের মালিক। তার বিরুদ্ধে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার প্রমাণ নেই। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে তাই আসামিকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’
রায়ে আসামির ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ হলেও তা স্থগিত রাখা হয়। আসামির নাম সুলতান আহমেদ। তিনি চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের হাজিয়ান গ্রামের বাসিন্দা।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ এমরান বলেন, ‘বিদেশ পাঠাতে ভিসা বিক্রির চুক্তিপত্র করে প্রতারণা করার অভিযোগে ২০১১ সালের নভেম্বরে সুলতান আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি এই মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। ৯ বছর মামলা চলতে থাকার পর গত ২৪ আগস্ট আসামিকে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। তবে আসামির বয়স ষাটোর্ধ্ব হওয়ায় ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় করে আদালত আসামিকে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন।’
জানা গেছে, ১২টি শর্ত আরোপ করে আদালত ছয় মাসের দণ্ডাদেশ স্থগিত করেন। আসামি সব নির্দেশনা যথাযথভাবে মানছে কিনা প্রবেশন কর্মকর্তা সে ব্যাপারে প্রতি তিন মাস পরপর প্রতিবেদন দিয়ে জানাবেন আদালতকে।
আদালতের দেওয়া শর্তগুলো হল— আসামি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত হবেন না, শান্তি বজায় রাখবেন ও ভাল ব্যবহার করবেন। আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তলব করলে যথাসময়ে উপস্থিত হবেন। কোন ধরনের মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করবেন না। নিয়মিত নামাজ পড়বেন। ভিসা গ্রহণ বা প্রদান সংক্রান্ত কাজে অংশগ্রহণ করবেন না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা কমপক্ষে দুটি বই পড়বেন। পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে ঘরের চারপাশে ৪০টি গাছ লাগাবেন। এলাকার সব বাসিন্দার সঙ্গে সু-সম্পর্ক রাখবেন। স্থানীয় ফাঁসিয়াখালী আশরাফুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার সব এতিমকে ছয় দিন একবেলা দুপুরের খাবার খাওয়াবেন। এর পাশাপাশি প্রত্যেককে একটি লুঙ্গি-গেঞ্জি দেওয়া ছাড়াও ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১০টি কোরআন শরিফ দান করবেন। স্থানীয় রশিদ আহমদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যেককে ১২টি বলপেন, ১০টি খাতা, একটি জ্যামিতি বক্স, একটি স্কুলব্যাগ ও একটি ভ্রমণবিষয়ক গল্পের বই কিনে দেবেন। সমাজের সদস্যদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত সুলতান আহমেদ বলেন, ‘সংশোধনের সুযোগ দেওয়ায় বিজ্ঞ বিচারকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এরই মধ্যে আমি বই, কলম, স্কুল ব্যাগ, জ্যামিতি বক্স ও খাতা কিনে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীদের দিয়েছি। আদালতের অন্যান্য নির্দেশনাও যথাযথভাবে পালন করব।’
আসামির আইনজীবী মজিবুর রহমান বলেন, ‘আদালতের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা মানতে আইনজীবী হিসেবেও ভূমিকা রাখব আমি।’
এদিকে আদালতের শর্ত মেনে রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজারের রশিদ আহমদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ৫০ শিক্ষার্থীকে স্কুল ব্যাগ ও পাঁচটি শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন শিক্ষাসামগ্রী গ্রহণ করে একটি চিঠিও দেন তাকে।
সিপি