ভিডিও/ কাউন্সিলর মোবারকের নামে শ্লোগান তুলে জমি দখলে গেল হামজারবাগের কিশোর গ্যাং

প্রাণনাশের হুমকিতে জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছেন এক নারী

তাদের কারও হাতে রামদা, কারও হাতে লাঠি। মারমুখী হয়ে সবাই এলো তারা। সংখ্যায় ৩০-৪০ জন। মুখে মুখে সবার স্লোগান— ‘মোবারক ভাই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে’, ‘তালেব ভাই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে।’

YouTube video

মনে হবে, কোনো রাজনৈতিক নেতার বন্দনা গাইতে কোনো ‘কিশোর গ্যাং’ রাস্তায় নেমেছে দল বেঁধে। আসল ঘটনা তা নয়। এই কিশোর গ্যাং নেমেছে চট্টগ্রামের ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী মোবারক আলী ও নগর ছাত্রলীগের সহ সভাপতি তালেব আলীর নামে এক অসহায় নারীর জমি দখল করতে।

এ সময় তারা ওই জমির মালিকের কেয়ারটেকার হোসনে আরা বেগম ও তার ছেলে ইকবাল হোসেনকে মারধর করে। তাদের ঘরে ঢুকে স্বর্ণ ও নগদ টাকা লুট করে চলে যায় বলেও অভিযোগ উঠেছে।

ঘটনাটি ঘটেছে গত ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার হামজারবাগের হামজা খাঁ লেইনের শাহ আমানত আবাসিকে। এ ঘটনায় ৫ জনকে আসামি করে অজ্ঞাতনামা ৩০-৪০ জনের বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করেছেন ওই জমির কেয়ারটেকার হোসনে আরা বেগম।

এ বিষয়ে পাঁচলাইশ থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই মো. তালেব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই-বাছাই করছি।’

ওই জমির সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ফিল্মি স্টাইলে ৩০-৪০ জনের কিশোর গ্যাং হাতে ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে শাহ আমানত আবাসিকের গেইট দিয়ে মিছিল নিয়ে প্রবেশ করে। রীনা আক্তার নামে এক নারীর মালিকানাধীন জমির ওপর থাকা সাইনবোর্ডে রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে তারা। আশপাশের ভবনের টিনের সীমানা প্রাচীরেও আঘাত দিতে দেখা গেছে তাদের। আবার ওই জমির পাশে থাকা কেয়ারটেকারের ঘরের দিকেও কয়েকজনকে জমায়েত হতে দেখা দেখেছে। দুই-তিন মিনিট অবস্থান নিয়ে তারা বেরিয়ে আসে।

এদিকে ওই জমির কেয়ারটেকার হোসনে আরা বেগমের দায়ের করা এজাহারে রব্বত আলীর সন্তান সাহেদ আলী রানা, তার ভাই নগর ছাত্রলীগের সহ সভাপতি তালেব আলী, যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ক্যাডার পেয়ার মোহাম্মদ, ওই এলাকার মোহাম্মদ ইলিয়াছের সন্তান দিদারুল আলম, সাহেদ আলী রানার কর্মচারী রাসেল প্রকাশ মাইকেলকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ৩০-৪০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

এদের মধ্যে নগর ছাত্রলীগের সহ সভাপতি তালেব আলী কোতোয়ালী থানার আলকরণ ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, শ্লীলতাহানিসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

এজাহারে হোসনে আরা বেগম আরও উল্লেখ করেন, হামজাবাগের শাহ আমানত আবাসিকে অবস্থিত পশ্চিম ষোলশহর মৌজার বিএস দাগ নম্বর ৫৪১৫ এবং মিউটেশন খতিয়ান ৫৮২৪ নম্বরের রীনা আক্তারের জমির ওপর গত ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে একদল যুবক। এ সময় তারা শ্লোগান দেয়— ‘মোবারক ভাই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে’ ‘তালেব ভাই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে’। পাশাপাশি তারা সাহেদ আলী রানা ও যুদ্ধাপরাধী সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ক্যাডার পেয়ার মোহাম্মদ পেয়ার মোহাম্মদের পক্ষেও একই ধরনের শ্লোগান দেয়।

তারা এ সময় হোসনে আরা বেগম ও তার ছেলে ইকবালের ওপর হামলা চালায় ওই কিশোর গ্যাং। তারা হোসনে আরার ঘরে ঢুকে দুই ভরি স্বর্ণ ও নগদ ৮ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। রীনা আক্তারের জমিতে থাকা সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে ক্ষতিসাধন করে বলে অভিযোগে জানানো হয়।

ভুক্তভোগী হোসনে আরা বেগম আরও উল্লেখ করেন, আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে জমির মালিক রীনা আক্তারের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে আসছে। তাদের দাবিকৃত চাঁদা পরিশোধ না করলে এই জমি ছেড়ে চলে যেতে একের পর এক হুমকি দিচ্ছে। এমনকি তারা প্রাণনাশেরও হুমকি দিয়ে আসছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার ও পাঁচলাইশ থানায় কয়েকবার অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।

হোসনে আরার আশঙ্কা, আসামিরা যেকোনো সময় বেআইনিভাবে দখল করে জমির মালিক ও তাকে উচ্ছেদ করতে পারে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, আসামিরা তাকে ও জমির মালিক রীনা আক্তারকে অশ্লীল ও আপত্তিকর ভাষায় ইভটিজিং করে আসছে। এ কারণে নারী হিসেবে তিনি নিজে ও তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

হোসনে আরা বেগম এজাহারে অভিযোগ করেছেন, কাউন্সিলর প্রার্থী মোবারক আলী, ছাত্রলীগের সহ সভাপতি তালেব আলী, তার বড় ভাই সাহেদ আলী রানা ও যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ক্যাডার পেয়ার মোহাম্মদের নির্দেশ ও তাদের উপস্থিতিতেই এ হামলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জমির মালিক রীনা আক্তার বলেন, ‘তারা আমার জমি দখল করতে সব ধরণের চেষ্টা করেছে। আইনিভাবে মোকাবেলা করে পারেনি। ভূমির দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সহকারী কমিশনাররের কাছে সাহেদ আলী রানা মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছিল। দুই বছর শুনানির পর তা খারিজ হয়ে গেছে। এখন তারা আইনিভাবে না পেরে সন্ত্রাসী ভাড়া করে আমাকে আমার জমি থেকে উচ্ছেদ করতে চায়।’

রীনা আক্তার আরও বলেন, ‘গত ২১ ডিসেম্বর তারা কিশোর গ্যাং পাঠিয়েছে আমার জমিতে। তাদের সবার হাতে অস্ত্র ছিল। আমার সাইনবোর্ড ভেঙেছে। আমার জমির কেয়ারটেকার ও তার ছেলেকে মেরে ওদের ঘর থেকে লুট করেছে। আলকরণ ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী সালাহ উদ্দিনের নির্বাচনী খরচ তোলার নামে তালেব আলী আমার কাছ থেকে চাঁদা চাচ্ছে। সাহেদ আলী রানা ও পেয়ার মোহাম্মদ চাঁদা না দিলে এ জমি ছেড়ে দিতে বলছে। তারা ভয়ংকর সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ। তারা সবসময় আমাকে হুমকি দিচ্ছে জমি ছেড়ে দিতে। এ বিষয়ে সকল কাগজপত্রসহ আমি মহানগর পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের কাছেও অভিযোগ করেছি। এ বিষয়ে আমি পাঁচলাইশ থানার ওসি, এই জোনের ডিসি স্যারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। তারা আমাকে সহযোগিতা না করলে আমার পরিবার ও জানমালের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।’

যদিও কাউন্সিলর প্রার্থী মোবারক আলী ওই নারীর জমিকে ‘একটি রাস্তা’ ও সশস্ত্র কিশোর গ্যাংকে তিনি ‘এলাকার লোকজন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে। তবে এলাকায় জোর গুঞ্জন রয়েছে, কাউন্সিলর প্রার্থীর মোবারকের নির্দেশেই তালেব, রানা ও পেয়ার মোহাম্মদ ওই নারীর জমি দখলের পায়তারা করছেন।

তারা বলছেন, সাহেদ আলী রানা ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর চান্দগাঁও সদর সার্কেল সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর খতিয়ান বাতিল করে রীনা আক্তারের জমিতে চলাচলের রাস্তা হিসেবে দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। সাহেদ আলী রানা তার আবেদনের সপক্ষে কোনো কাগজপত্র দাখিল করতে না পারায় দুই বছর শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর চান্দগাঁও সদর সার্কেল সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ফোরকান এলাহি অনুপম তা খারিজ করে দেন।

সহকারী কমিশনার কার্যালয়ের পক্ষ থেকে সার্ভে করে পশ্চিম ষোলশহর মৌজার বিএস দাগ নম্বরের ৫৮২৪ নম্বর মিউটেশন খতিয়ান সৃজন করেন। সরকারে নামে বিএস খতিয়ান রেকর্ড থাকা একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিকে কাউন্সিলর প্রার্থী মোবারক আলীর পক্ষ থেকে ‘রাস্তা’ হিসেবে অভিহিত করাকে ভূমি দখলের চেষ্টা বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী মোবারক আলী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওই এলাকায় কেউ একজন সাইনবোর্ড দিয়ে জায়গা দখল করে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। এলাকার লোকজন সেটা অপসারণ করেছে। এ বিষয়ে তারা আদালতে মামলাও দায়ের করেছে। বিষয়টি পুলিশ জানে। আমার নামে স্লােগান দিয়ে জায়গা দখলের বিষয়টি সত্য নয়। আমি কখনও কাউকে ন্যায়বিরোধী কাজে উৎসাহিত করি না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm