কর্ণফুলী গ্যাসে জালিয়াতি/ ২০ পদে নিয়োগ ৩৮, ভুয়া ৩২ জনই!

৯ বছর আগের এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল ২০টি পদ, অথচ তার বিপরীতে নেওয়া হয়েছে ৩৮ জন। অথচ এর মধ্যে মেধাতালিকায় মিলেছে মাত্র ছয়জনের নাম। বাকি ৩২ জনের নিয়োগ পুরোটাই প্রশ্নবিদ্ধ। এদের নিয়োগ পরীক্ষার কোনো নথি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার খাতা—কিছুই পাওয়া যায়নি। কারও কারও সনদও জাল। কেউ কেউ পাশের আগে পাশ দেখিয়ে সার্টিফিকেট জমা দিয়েছে নিয়োগের সময়। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা বেরিয়ে এসেছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (কেজিডিসিএল)।

২০১০ সালের ১১ ডিসেম্বর দৈনিক সমকাল পত্রিকায় একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কেজিডিসিএল। ওই বিজ্ঞপ্তিতে মোট ২০টি পদে আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা পদের মধ্যে রয়েছে সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল/মেকানিক্যাল/কেমিক্যাল/ইলেকট্রিক্যাল), সহকারী ব্যবস্থাপক (সাধারণ), সহকারী ব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব), সহকারী কর্মকর্তা (সাধারণ), সহকারী কর্মকর্তা (অর্থ ও হিসাব), উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল/মেকানিক্যাল/কেমিক্যাল/ইলেকট্রিক্যাল/অটোমোবাইল)।

দুদক সুত্রে জানা যায়, ওই ২০টি পদের বিপরীতে সহকারী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ৩৮ জনকে। নিয়োগ পাওয়া ৩২ জন পরীক্ষার্থীর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার খাতা, নিয়োগ পরীক্ষার কোন নথিপত্রসহ কোনো তথ্যপ্রমাণই নেই। এমনকি নিয়োগ কমিটির সদস্যদের তালিকাও পাওয়া যায়নি দুদকের অনুসন্ধানে।

৩২ জন সহকারী কর্মকর্তার নিয়োগের বৈধতা বিষয়ে কাস্টডিয়ান ও পেট্রোবাংলায় চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হলেও তার কোন জবাব পায়নি দুদক। এছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম) থেকে ওই নিয়োগপ্রাপ্তদের লিখিত পরীক্ষার রিপোর্ট চাওয়া হলেও তারা এ সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি। লিখিত পরীক্ষার কিছু নথিপত্র যাচাইবাছাই করে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে মেধাতালিকায় থাকা মাত্র ছয়জন পরীক্ষার্থীর নাম পাওয়া যায়।

দুদক সূত্রে জানা যায়, ৩৮ জন কর্মকর্তা নিয়োগের মধ্যে বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীই ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর এবং চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও সাতকানিয়ার। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন ধরনের কোটার কথা উল্লেখ থাকলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছে নিয়োগকালে। কোটা থাকলেও বৃহত্তর ময়মনসিংহ, বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনীর কোন পরীক্ষার্থী ছিল না। এছাড়া নিয়োগ পাওয়া ৩২ জনের অনেকেই জাল সনদ কিংবা অনিবন্ধিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ এবং পাশের আগে পাশ দেখিয়ে সার্টিফিকেট জমা দিয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়োগপ্রাপ্তদের একজন মহিউদ্দিন চৌধুরী নামে সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) নিয়োগ পান। ওই সময় তিনি বেসরকারি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। তিনি অনার্স না করেই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জাল সনদ তৈরি করে চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে চাকরিতে যোগদানের আরও প্রায় দুই বছর পর তিনি অনার্স পাশ করেন। তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার করইয়ানগর এলাকার আইয়ুব খান চৌধুরীর পুত্র। তার পিতা আইয়ুব খান চৌধুরীও সাবেক পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) পদে কর্মরত ছিলেন।

কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ফিরোজ খান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ১১ ডিসেম্বর ২০১০ সালের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তালিকায় ৩৮ জনকে নিয়োগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন একটি তদন্ত টিম কাজ করছে। তদন্ত রিপোর্টে সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান।

কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খায়েজ আহমদ মজুমদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘৩৮ জন নিয়োগের বৈধতা নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় যারা সঙ্গে জড়িত তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ২০১০ সালের ১১ ডিসেম্বর একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোন নিয়ম না মেনে ও অসৎ উপায়ে ৩৮ জন পরীক্ষার্থীকে নিয়োগ দিয়েছে কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে মাত্র ৬ জন পরীক্ষার্থীকে মেধাতালিকায় পাওয়া গেছে। বাকি ৩২ জন পরীক্ষার্থীর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার কোন নথিপত্র পাওয়া যায়নি। এছাড়া ২০টি পদের স্থলে নিয়োগ দিয়েছে ৩৮ জনকে। অধিকাংশ নিয়োগই আর্থিক লেনদেন, স্বজনপ্রীতি ও প্রভাবশালীর তদবিরে নিয়োগ পায় বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

দুদক কর্মকর্তা জানান, ইতিমধ্যে অনুসন্ধানের রিপোর্ট দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট আসার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!