কর্ণফুলীর বুকে মরণফাঁদ ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা নৌরুট, ধারণক্ষমতার চারগুণ বেশি যাত্রী

ডিসির সঙ্গেও ‘কথা বলার টাইম নাই’ ইজারাদার ইসহাকের

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর পাড়ঘেঁষা গ্রাম ডাঙ্গারচর। দৈনন্দিন কাজ সারতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নদী পার হয়ে শহরে আসেন। এজন্য এখানকার মানুষের একমাত্র ভরসা ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা ঘাট। কিন্তু এই ঘাটে ইজারাদারের দাপটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে যাতায়াতকারী যাত্রীরা।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও প্রতিদিন জীবিকার তাগিদে অনেকে গ্রাম থেকে শহরে এসে চাকরি-ব্যবসা করে থাকেন। সড়কপথে আসতে গেলে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এজন্য সময় বাঁচাতে নদীপথকেই বেছে নিয়েছে ডাঙ্গারচরের মানুষ। কিন্তু সেই নদীপথেও তাদের প্রতিনিয়ত পোহাতে হয় ভোগান্তি। অনেক সময় গুনতে হয় দ্বিগুণ ভাড়া। প্রতিদিনই নৌকায় ধারণক্ষমতার বাইরে যাত্রী নেয়া হয়, সঙ্গে থাকে মালমালও। বলতে গেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পাড়ি দিতে হয় নদী। এই নৌরুট এখন যাত্রীদের জন্য মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, যাত্রীর বাড়তি চাপ থাকায় ধারণক্ষমতার বাইরে দুই থেকে তিনগুণ বেশি যাত্রী নেয়া হয় নৌকায়। পারাপারে নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা হলেও যাত্রীদের গুনতে হয় দ্বিগুণ। অতিরিক্ত যাত্রী নেয়ার ফলে ২০০৯ ও ২০১২ সালে ১০-১২ জন যাত্রী নদীতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ইজারাদারের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে প্রশাসন জরিমানা করলেও পরিবর্তন হয়নি ঘাটের দৃশ্যপট। এই ঘাট দিয়ে চরলক্ষ্যা এবং ডাঙ্গারচরের অন্তত ৮ হাজার মানুষ নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। ডাঙ্গারচর রহমানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ডাঙ্গারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হালিশহর বেগম জান উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও প্রতিদিন নৌকাযোগে নদী পারাপার হয়। বাসাভাড়া কম হওয়ায় শিল্পকারখানার অনেক শ্রমিক নদী পার হয়ে এই এলাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। অথচ ব্যস্ততম এই ঘাটে ভরসা মাত্র দু’টি নৌকা। একটি নৌকার ধারণক্ষমতা ১২ জনের হলেও পারাপার করে প্রায় ৬০ জনের বেশি। আবার দুপুরে বন্ধ রাখা হয় একটি নৌকা।

এ নিয়ে গত ২১ মার্চ যাত্রীসেবা এবং নিরাপদ যাত্রী পারাপারের লক্ষ্যে ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা যাত্রী পারাপার পাটনী শ্রমজীবী সমবায় সমিতি ও ইজারাদারের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানিসহ নানান অভিযোগ এনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, জেলা প্রশাসক, উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি দেন স্থানীয়রা।

বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পারাপারের জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো চালানো হচ্ছে অদক্ষ চালক দিয়ে। এই ঘাট দিয়ে শিশু ও নারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ নদী পার হচ্ছেন। নৌকায় যাত্রী ওঠা-নামায় রয়েছে নানা সমস্যা। ঘাটে মানুষের তুলনায় নৌকা কম থাকায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে যাত্রীদের। উপায় না থাকায় বাড়তি ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি করে নৌকায় উঠছেন যাত্রীরা।

স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম হৃদয় বলেন, ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা ঘাটটি পুরোপুরি চলছে আল্লাহর ওয়াস্তে। ২০১৭ সালে এলাকাবাসী যাত্রীদের হয়রানি ও অতিরিক্ত যাত্রী বহনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। কয়েকদিন না যেতেই পরিস্থিতি আবার আগের মতো হয়ে যায়। ১২ জনের নৌকায় ৬০/৭০ জন যাত্রীও নেয়া হয়। যাত্রীর এমন ভিড়ের মধ্যে মালামালও বোঝাই করা হয়। নৌকার পাশ দিয়ে বন্দরের বড় জাহাজ আসা-যাওয়ার সময় মনে হয় এই বুঝি নৌকা ডুবে যাচ্ছে। ২০০৯ ও ২০১২ সালে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাইয়ের ফলে নৌ দুর্ঘটনায় প্রায় ১০ থেকে ১২ জন স্থানীয় বাসিন্দা প্রাণ হারান।

তিনি আরও বলেন, ইজারাদাররা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাখছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের কপালে জুটে মারধর। এ ঘাট চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন থেকে ইজারা দেয়া হলেও যথাযথ তদারকি নেই। চসিক এ ঘাট থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে। কিন্তু ঘাটের যাত্রীসেবায় কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। তদারকির অভাবে এ ঘাটে দুর্ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি নিয়ে যাত্রীরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগাদা দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

জানা যায়, আগের ইজারাদার মোহাম্মদ ওসমান সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বকেয়া রাখার কারণে কালো তালিকাভুক্ত হলে ঘাটটি সুকৌশল ইজারা নেন মোহাম্মদ ইসহাক।

এ বিষয়ে জানতে ইজারাদার মোহাম্মদ ইসহাকের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি বলেন, আমি কোনো ইজারাদার না। ডিসির সঙ্গে কথা বলার টাইম নাই, সাংবাদিকদের সঙ্গে কী কথা বলব౼বলে কল কেটে মোবাইল বন্ধ করে দেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, এ ঘাটের বিষয়ে লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। গতকালকে আমি জেনেছি। তবে আমরা আমলে রেখেছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনা সুলতানা বলেন, ঘাটের ইজারাদারের অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। তবে ঘাটটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধীনে। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কর্ণফুলীর প্রতিটি ঘাটে ভাড়া ও যাত্রী নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। নজরদারিসহ বিভিন্ন সময়ে ঘাটে অভিযান পরিচালনা করে ইজারাদারদের জরিমানাও করা হয়েছে।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!