করোনা ঠেকাতে নতুন কৌশল, দেশেও যাচাইয়ের প্রস্তাব চবি শিক্ষকের

করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) এ আক্রান্ত হয়ে সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে উঠা ব্যক্তির ব্লাড-প্লাজমা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করলে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

এই এন্টিবডি থেরাপি তথা ব্লাড-প্লাজমার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করে সফল হওয়ার বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য উপস্থাপন করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া।

সোমবার (১৩ এপ্রিল) ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস দেন।

তিনি ফেসবুকে লিখেন, ‘আমরা কি পারিনা করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে শেষ চেষ্টা হিসেবে পরোক্ষ এন্টিবডি থেরাপি তথা ব্লাড-প্লাজমার ক্লিনিকেল ট্রায়াল শুরু করতে?’

এ পদ্ধতিতে করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে সম্পুর্ণ নিরাময় হয়ে উঠা ব্যক্তির ব্লাড-প্লাজমা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করলে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত নিরাময় হয়ে উঠতে পারে।

সম্প্রতিক কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর উপর প্রয়োগ করা চীনের দুটি পাইলট ষ্টাডির ফলাফল প্রকাশ করেছে নামকরা বিভিন্ন গবেষণা সাময়িকী ও দৈনিক পত্রিকা গুলো। একটি ষ্টাডিতে দেখা গেছে, উহান শহরের ডাক্তাররা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত থেকে নিরাময়কারীর ব্লাড প্লাজমা (কনভালেসসেন্ট প্লাজমা) করোনাভাইরাসে মারাত্মক আক্রান্ত ১০ জন রোগীর উপর প্রয়োগ করে দেখলেন যে রোগীর ভাইরাসের লেভেল দ্রুত কমে গেছে এবং তিন দিনের মধ্যে রোগী ছোট-ছোট নি:শ্বাস ও বুকে ব্যাথা থেকে অনেক উন্নতি হয়ে জ্বর ও কমে এসেছে।

এ সংক্রান্ত স্টাডি রিপোর্টটি বিখ্যাত গবেষণা সাময়িকী প্রসেডিংস অফ দি ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সস (Proceedings of the National Academy of Sciences, PNAS) এ এপ্রিলের ৬ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে।

অন্য আরেকটি পাইলট স্টাডি চীনের শেনজেন থার্ড পিপলস হসপিটালের ডা: লেই লিও এর নেতৃত্বে হয়। এখানেও করোনাভাইরাসে মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত ৫ জন রোগীর উপর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত থেকে নিরাময় হয়ে উঠা ব্যক্তির ব্লাড-প্লাজমা প্রয়োগ করে ১০ দিনের মধ্যে ভাল ফলাফল পেয়েছে এবং ৩ জনের ভেন্টিলেটর খুলে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন।

এ সংক্রান্ত স্টাডি রিপোর্টটি খ্যাতনামা গবেষণা সাময়িকী জার্নাল অফ দি আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েসন (Journal of the American Medical Association, JAMA) এ ২৭ মার্চ ২০২০ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে নিরাময় হয়ে উঠা ব্যক্তির ব্লাড-প্লাজমা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীর জন্য সাহায্য মর্মে এ দুটি স্টাডি রিপোর্ট খ্যাতনামা দি গার্ডিয়ান (The Guardian) পত্রিকায় ৭ এপ্রিলে ২০২০ প্রকাশিত হয়।

তুরস্কের আনাদোলু এজেন্সী পত্রিকায় ১০ এপ্রিল ২০২০ তারিখে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ইনোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা: আহমেট কিজিলে ৫৬ বছর বয়সের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজন রোগীর উপর অন্যান্য চিকিৎসার সাথে করোনা ভাইরাস হতে নিরাময়কারীর ব্লাড-প্লাজমা প্রয়োগ করে ভাল ফলাফল পেয়েছেন এবং তা কোনরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া।

আমেরিকার এফ.ডি.এ. ব্লাড-প্লজমার পরীক্ষামূলক ব্যবহারের একটা গাইডলাইন দিয়েছে তাদের ওয়েব সাইটে ৮ এপ্রিল ২০২০। এর আগেই ব্লাড-প্লাজমা ব্যবহারের অংশ হিসেবে নিউইর্য়কের মাউন্ট সিনাই হসপিটালে মার্চের শেষ সপ্তাহের দিকে ডা: জেফরী জাং ব্লাড-প্লাজমা সংগ্রহ করেন করোনা আক্রান্ত থেকে নিরাময়কারী ব্যক্তি থেকে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেক অসুস্থ লোক এবং এ পদ্ধতিটি হতে পারে গেম চেন্জার হিসেবে। এটা এনবিসি নিউজে গত ৬ এপ্রিলে প্রকাশিত হয়েছে।

টেক্সাসে মায়ো ক্লিনিককে এফ.ডি.এ. থেকে বলা হয়েছে, ব্লাড-প্লাজমা সংক্রান্ত চিকিৎসার কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য। তারপর থেকে সেখানকার অনেক হাসপাতাল রেজিস্ট্রেশন শুরু করেছে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করার জন্য। রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে দি টেক্সাস ট্রিবিউন (The Texas Tribune) এর ১১ এপ্রিল ২০২০ সংখ্যায়।

দক্ষিন কোরিয়ার এরিরেং নিউজে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজন ৬৭ বছর বয়সী মহিলা ও একজন ৭১ বছর বয়সী পুরুষের উপর ব্লাড-প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে কার্যকর ফল পেয়েছে।

ভারতের দি প্রিন্ট (The Print) পত্রিকায় ৯ এপ্রিল ২০২০ এ প্রকাশিত সংবাদে দি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইপিডেমিয়োলজীর পরিচালকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ভারত শীঘ্রই ব্লাড-প্লাজমার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করবে এবং তা হবে করোনাভাইরাসে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ভেন্টিলেটর ব্যবহারকারী রোগীর উপর।

পাকিস্তানে গত ২ এপ্রিল জিও নিউজে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ডা: সাকিব আনসারি করোনাভাইরাস আক্রান্ত হতে নিরাময় হয়ে উঠা ইয়া জাফরী নামক ব্যক্তির ব্লাড-প্লাজমা সংগ্রহ করেছেন করোনাভাইরাসে মারাত্মক আক্রান্ত রোগীর উপর প্রয়োগ করার জন্য।

এ বিষয়ে ড. রবিউল হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমেরিকা, চীন, দক্ষিন কোরিয়া, তুরস্ক, ভারত ও পাকিস্তান এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। আমাদের দেশও করতে পারে। এটা জটিল কোন ট্রায়াল নয়, ব্লাড দেওয়ার মত একটা প্রক্রিয়া। সব দেশের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হতে ফলাফল দেখে আমরা ট্রায়াল করবো, এটা না ভেবে এইচ১এন১, সার্স, ইবেলায় ব্লাড-প্লাজমার সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে অতীত অভিজ্ঞতা গ্রহন করতে হবে আমাদের। পাশাপাশি সম্প্রতিক সময়ে করোনাআক্রান্ত মুমূর্ষ রোগীর উপর চীনের ব্লাড-প্লাজমার পাইলট চিকিৎসার অভিজ্ঞতা নিয়েই আমাদের দেশে ব্লাড-প্লাজমার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা উচিত।’

তিনি আরো বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৩৬ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত হতে নিরাময়কারী ব্যক্তি আমরা পেয়েছি, তাদের কাছ থেকে ব্লাড সংগ্রহ করে (ভাইরাস ও অন্যান্য স্ক্রিনিংয়ের পর) অন্ততপক্ষে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ও ভেন্টিলেটর ব্যবহারকারী ১০ জন রোগীকে তাদের অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি পাইলট ক্লিনিক্যাল স্টাডি হিসেবে ব্লাড-প্লাজমা প্রয়োগ করলে হয়তো মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে।’

এমআইটি/এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!