করোনাসন্দেহে গর্ভবতীদের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল হয়ে উঠেছে ‘দোজখখানা’, আবার সেই পুরনো ছবি

৫ ল্যাব আলট্রাসনোগ্রাফি করাতেও রাজি হয়নি এক গর্ভবতী নারীর

চট্টগ্রামে আবার স্বরূপে ফিরছে করোনার সংক্রমণ। এমন পরিস্থিতিতেও চট্টগ্রামের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয় করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে। উল্টো দুই ওয়ার্ডবিশিষ্ট ‘রেড জোন’ নামিয়ে আনা হয়েছে এক ওয়ার্ডে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই হাসপাতালটির ঝুলিতে রয়েছে করোনা চিকিৎসায় গত দুই বছরের অভিজ্ঞতা। এখন যখন করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তখন পদে পদে দিয়ে চলেছে অব্যবস্থাপনার প্রমাণ। এর মধ্যে এই অব্যবস্থাপনার সবচেয়ে করুণ শিকার হচ্ছেন করোনা শনাক্ত হওয়া প্রসবপূর্ব ও প্রসূতি মায়েরা। এ ধরনের রোগীর স্বজনরা যাকে বর্ণনা করছেন ‘দোজখ’ হিসেবে।

অন্যদিকে শ্বাসকষ্টের রোগীরা আবার নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল, ডাক্তার ও ল্যাবগুলোতে হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের গর্ভবতী নারীদের জন্য সময়টা হয়ে ওঠেছে রীতিমতো নরক যন্ত্রণার সমান। তাদের কারও করোনার উপসর্গ থাকলে গর্ভকালের সবচেয়ে জরুরি ও স্পর্শকাতর মুহূর্তটিতেই ডাক্তারের সহায়তা পাচ্ছেন না, এমনকি জরুরি পরীক্ষা করাতে চাইছে না চট্টগ্রামের ল্যাবগুলোও। গত শনিবার (১৫ জানুয়ারি) করোনাসন্দেহে শ্বাসকষ্টে ভোগা এক গর্ভবতী নারীর আলট্রাসনোগ্রাফ পরীক্ষা করাতে রাজি হয়নি পাঁচ পাঁচটি নামিদামি ল্যাব। সেই নারীকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের রেডজোনেও স্থান দেওয়া হয়নি, গর্ভবতী জেনেও তাকে রাখা হয় খোলা বারান্দার মেঝেতে। তিন দিন পর ওই নারী নিদারুণ কষ্ট সয়ে মারা যান।

সরেজমিনে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রাম মেডিকেলে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ‘রেড জোনে’ প্রসবপূর্ব তিনজন হবু মা করোনা পজিটিভ হয়ে ভর্তি হন। এর মধ্যে একজন মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) বাচ্চা প্রসবের পর রেড জোনের ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউতে মারা গেছেন। বাকি দুজনের একজন বাচ্চা প্রসবের অপেক্ষায় রয়েছেন। অপর একজন প্রসব-পূর্ববর্তী করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার অবস্থা অবশ্য শঙ্কামুক্ত।

মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) শামসুন্নাহার নামের এক ২৬ বছর বয়সী নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার পরপরই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা রেড জোনের আইসিইউতে মারা গেছেন। ওইদিন দুপুরে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেছেন স্বজনরা। নবজাতক ওয়ার্ডে ঠাঁই না মেলায় জন্মেই মা হারানো নবজাতক পুত্রটিকে বর্তমানে কেবিনে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, ওই শিশুর অবস্থাও আশংকাজনক।

সন্তান জন্ম দিয়ে মারা যাওয়া শামসুন্নাহারের ভাই দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার বোনকে শনিবার (১৫ জানুয়ারি) থেকে মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) পর্যন্ত যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তাকে দোজখই বলা যায়। কী ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা হল আমাদের পরিবারে!’

মৃত্যুর আগে বোনের দুঃসহ কষ্টের কথা বলতে গিয়ে দেলোয়ার হোসেন জানান, তার বোন শামসুন্নাহার চট্টগ্রাম নগরীর পূর্ব মাদারবাড়িতে থাকতেন। স্বামীর নাম সাইফুল ইসলাম। শামসুন্নাহারের বাচ্চা প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ডাক্তার দিয়েছিলেন ফেব্রুয়ারির শেষে। কিন্তু গত শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যা থেকে জ্বরের সঙ্গে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে থাকে তার। শামসুন্নাহার মেমন হাসপাতালের ডা. কাকলীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন নিয়মিত। পরে আন্দরকিল্লার মেডিল্যাবে ডা. সুলেখা ঘোষকে দেখাতেন। শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে শনিবার (১৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় তাকে লালদিঘি পাড়ের মেডিল্যাবে চেম্বার করা ডা. সুলেখা ঘোষের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ডাক্তার শামসুন্নাহারকে করোনা পরীক্ষা ও আলট্রাসনোগ্রাফ করানোর পরামর্শ দিলেও রোগীর অবস্থা দেখে নিজে আলট্রাসনোগ্রাফ করাতে রাজি হননি। এর বদলে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ওই রাতেই মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে বলা হয়, আলট্রাসনোগ্রাফ পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে।

সিএনজি ট্যাক্সিতে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা শামসুন্নাহারের শরীরে ততোক্ষণে পানি চলে এসেছে। তার শরীর ফুলে যাচ্ছিল। সঙ্গে তীব্র শ্বাসকষ্ট লেগেই আছে। স্বজনরা এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে কারও কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে শামসুন্নাহারকে নিয়ে ওই সিএনজিতেই ছুটে যান জামালখানের সেনসিভে। কিন্তু রোগী দেখে সেনসিভও রাজি হয় না। স্বজনরা এরপর ছুটে যান জামালখানের ল্যাব এক্সপার্টে। না, সেখানেও না করে দেওয়া হয়। সিএনজি ট্যাক্সিটি চলতেই থাকে। সংকটাপন্ন শামসুন্নাহারকে এরপর নিয়ে যাওয়া হয় আন্দরকিল্লার এপিক হেলথ কেয়ারের সামনে। অনেক কাকুতি-মিনতি করেও স্বজনরা এপিকের লোকজনকে রাজি করাতে পারেননি আলট্রা করাতে। রোগীর শ্বাসকষ্ট ও গর্ভবতী জেনে শুরুতেই না করে দেওয়া হয়।

বোনকে নিয়ে ছুটোছুটির করুণ পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে দেলোয়ার হোসেন জানান, শেষে তার এক পরিচিত বন্ধু পাঁচলাইশের পিপলস হাসপাতালে তার বোনকে আলট্রোসানোগ্রাফি ও করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। বোনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হলে বন্ধুর পরামর্শে শনিবার (১৫ জানুয়ারি) রাতে তাকে পিপলস হাসপাতালেই ভর্তি করানো হয়। কিন্তু শামসুন্নাহারের অবস্থার অবনতি হচ্ছিল ক্রমেই। পরদিন পিপলসের ডাক্তাররা তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন।

রোববার (১৬ জানুয়ারি) গর্ভবতী শামসুন্নাহারকে ভর্তি করানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেলের নিচতলায় করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত রেড জোনে। ভর্তির পর থেকেই এমন গুরুতর রোগীকে রাখা হয় রেড জোনের বাইরে— খোলা বারান্দায়। মেঝের প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যেই কাটাতে হয় তাকে। পরে ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় রোগীকে সিজার করানো হয় ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে। প্রসূতি ওয়ার্ডের ৩ থেকে ৪ জন সহকারী অধ্যাপক পদবির ডাক্তারের নিবিড় তত্ত্বাবধানে শামসুন্নাহারের সিজার করানো হয়। এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন তিনি।

এরপর বাচ্চাকে নবজাতক ওয়ার্ড পাঠানো হয়। অন্যদিকে মাকে পাঠানো হয় করোনা রেড জোনে। কিন্তু সদ্য মা হওয়া শামসুন্নাহারের জায়গা হয় যথারীতি রেডজোনের বাইরে সেই খোলা বারান্দায়।

রোববার (১৬ জানুয়ারি) সারা রাত মেঝের ঠান্ডা ও রাতের বাতাস গায়ে লেগে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় শামসুন্নাহারের। পরে অনেকটা তদবির করে তাকে রেডজোনের আইসিইউতে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু ততোক্ষণে শামসুন্নাহারের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে আসতে থাকে। তিনি তখন প্রায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যেতে থাকেন।

মা যখন আইসিইউতে, তখন শামসুন্নাহার গর্ভে জন্ম নেওয়া নবজাতক শিশুটিকে সোমবার (১৭ জানুয়ারি) দুপুর ২টায় হঠাৎ করে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৩২ নম্বর নবজাতক ওয়ার্ড থেকে ছাড়পত্র দিয়ে তাকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয়। স্বজনরা মা ও শিশু হাসপাতালে ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে বাচ্চাটিকে নিয়ে গেলেও সেখানে ঘন্টাদুয়েক অপেক্ষা করে জানা যায়, নবজাতকটিকে রাখার এনআইসিইউ সেখানে খালি নেই।

পরে চট্টগ্রাম মেডিকেলের নবজাতক ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. জগদীশ চন্দ্র দাশকে মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানানো হলে তিনি বাচ্চার মামাকে এবার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম মেডিকেলের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের দায় সারার প্রবণতায় আপত্তি তুলে জানান, নবজাতককে চট্টগ্রাম মেডিকেলের নবজাতক ওয়ার্ডেই রাখতে হবে। পরে অনেকটা পীড়াপিড়িতে শামসুন্নাহারের নবজাতক শিশুপুত্রটিকে আবার মেডিকেলের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করে কেবিনে নিয়ে আলাদা করে রাখা হয়।

জন্মের পরপরই যখন এমন সব মর্মান্তিক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছিল নবজাতক শিশুটি, চট্টগ্রাম মেডিকেলের আইসিইউতে তখন তার মা মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে গেছেন। মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) নবজাতক শিশুটিকে এতিম করে দিয়ে শামসুন্নাহার নামের ২৬ বছর বয়সী নারীটি চট্টগ্রাম মেডিকেলের আইসিইউতে জীবনের শেষ নিশ্বাসটি ফেলে চলে যান পৃথিবী ছেড়ে।

এদিকে মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যা পর্যন্ত শিশুটির অবস্থাও আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে বলে জানান নবজাতকের মামা দেলোয়ার হোসেন।

উল্টো সংক্রমণ বাড়াচ্ছে মেডিকেলের রেডজোন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শামসুন্নাহারের সঙ্গে ভর্তি হওয়া বাকি যে দুজন প্রসূতি মা চট্টগ্রাম মেডিকেলের করোনা রেড জোনে আছেন, তাদের কয়েক দফায় ৩৩ নম্বর প্রসূতি ওয়ার্ড নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে একজন বাচ্চা প্রসবের পর রেড জোনে চিকিৎসাধীন আছেন বর্তমানে। তাকেও রেড জোনের বারান্দায় রাখা হয়েছিল টানা দুইদিন। বাকি যে একজন প্রসবপূর্ব হবু মা সেখানে আছেন, তার যখনই লেবার পেইন উঠছে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রসূতি বিভাগ ৬ তলায় অবস্থিত হওয়ায় রোগী ও করোনা আক্রান্ত হবু মা একই লিফটে ওঠানামা করছেন। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এই রোগীটিরও অক্সিজেন স্যাচুরেশন ওঠানামা করছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. শর্মিলী বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে করোনা আক্রান্ত প্রসবপূর্ব হবু মায়েদের জন্য আলাদা ও সুরক্ষিত কর্নার করেছি। প্রসবপূর্ব হবু মাকে প্রথমে করোনা রেড জোনে ভর্তি করানো হয়। তারপর লেবার পেইন উঠলে ওয়ার্ডে আনা হয়। কিন্তু আসা-যাওয়ার পথ ও সময়টা অনেক সময় হবু মায়ের সংক্রমণ সাধারণ রোগীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।’

ডা. শর্মিলী বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা গাইনি ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিজার করছি। বাচ্চা ডেলিভারি করাচ্ছি। কিন্তু সেই রোগী রেডজোনে গিয়ে অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছে। এতে আমরা কী করতে পারি? একজন প্রসবপূর্ব হবু মা আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই করোনায় আক্রান্ত হয়। তার ফুসফুস সংক্রমিত হয়। রেড জোনে গিয়ে গায়ে ঠান্ডা লাগার পর এ সংক্রমণের হার আরও বেশি হয়।’

চট্টগ্রাম মেডিকেলের রেড জোনের ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স শফিকুর নূর জানান, মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) পর্যন্ত রেড জোনে করোনা রোগী ভর্তি আছেন ৬০ জন।

করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের নিচতলায় দুটি ওয়ার্ড মিলে ‘রেড জোন’ করা হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় ঢেউয়ে করোনা রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে শুরু করলেও রোগী রাখা হচ্ছে মাত্র একটি ওয়ার্ডেই।

অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রসব-পূর্ব ও প্রসূতি মায়েদের কেন রেড জোনের বাইরে বারান্দায় রাখা হচ্ছে— এমন প্রশ্নে শফিকুর নূর বলেন, ‘সিট না থাকলে রোগী তো বাইরে রাখতেই হবে। তবে বুধবার থেকে আরেকটি ওয়ার্ডকে রেড জোন বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে।’

তবে রেড জোনে প্রসূতিদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই বলে জানান করোনার রেড জোনের এই ইনচার্জ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm